২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০২

মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া, আইন কী বলে?

 

বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও মারধরের ঘটনা ঘটছে। বাসা থেকে বের হলেই ধাওয়া করে মারধর করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে বেধড়ক পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। অনেককে বাড়িতে গিয়েও ধরে আনা হচ্ছে। মারধরে অনেকে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখান থেকেই পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেককে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে  জেলে পাঠাচ্ছে পুলিশ। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে। 

কিন্তু এভাবে কাউকে ধরে পিটিয়ে আহত করে পুলিশে দেয়াকে দেশের প্রচলিত কোনো আইনই সমর্থন করে না; বরং নাগরিককে মারধরের ঘটনা গুরুতর অপরাধ হিসেবে আইনে শাস্তিযোগ্য। এসব ঘটনা পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী হলেও এ পর্যন্ত মামলা বা ব্যবস্থা নেয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এডভোকেট জয়নাল আবেদিন মানবজমিনকে বলেন, এটা জঘন্যতম অপরাধ। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক এই ধরনের অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন না। সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা যা করছেন তা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।

সংবিধানে কাউকে সাধারণ মানুষকে বাসা থেকে ধরে এনে পুলিশে দেয়ার অধিকার দেয়নি। এটা বেআইনি। এমন অবস্থায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কি কাউকে পুলিশের কাছে তুলে দিতে পারেন? তারা কি কাউকে আটক করতে পারেন?  

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মহসিন রশিদ মানবজমিনকে বলেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ কি স্টাইকিং ফোর্স? বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তারা আটক করার কে? রাষ্ট্রের একজন নাগরিককে ভিন্নমতের কারণে কেউই মারধর করতে পারেন না। সেখানে যদি মারধর করে পুলিশে দেয়া হয় সেটা বিদ্যমান আইনের লঙ্ঘন। আইন কাউকে এই এখতিয়ার দেয়নি। পুলিশও কাউকে মারধর করতে পারেন না। তাদের এই অধিকার নেই। সেখানে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কীভাবে মারধর করে? আসলে একটা দেশে যখন বিচারব্যবস্থা ও জবাবদিহিতার সকল স্তর ভেঙে পড়ে তখন এমন ঘটনা অহরহ ঘটে। ভিন্নমতের কারণে কাউকে মারধর করে পুলিশে তুলে দেয়া চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। 

এ ব্যাপারে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক মানবজমিনকে বলেন,  শুধু ভিন্নমত বা ভিন্ন রাজনীতি করার জন্য নয়, কোনো অবস্থাতেই একজন মানুষকে কেউ মারধর করতে পারে না। সরকারদলীয় নেতাকর্মী নয়, কাউকে মারধর করার ক্ষমতা কারও নাই। এটা পুলিশও করতে পারে না। আইনে এটা সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। কারও গায়ে হাত তোলার ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয়নি। আর কেউ যদি অপরাধ না করে, তাকে কেউ পুলিশে দিতে পারে না। তবে যদি অপরাধ করে, তাহলে তাকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দিতে পারে, কিন্তু মারধর করার এখতিয়ার কারও নেই। এমন ঘটনা কোথাও ঘটলে সেটা আইন লঙ্ঘন হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। এখানে আইনের চরম ব্যত্যয় ঘটেছে। আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। যদি গায়ে হাত তোলে, তাহলে যারা হাত তুলবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধিতে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাদের শাস্তি হবে। শাস্তি হওয়া উচিত। কেউ যদি অপরাধও করে তারপরও তাকে মারতে পারবে না। তখন তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, গ্রেপ্তার হতে পারে। কিন্তু মারার অধিকার কারও নাই।  

আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, প্রথমে বলবো, আপনি ইচ্ছা করলেই কাউকে মারধর করতে পারেন না। আইন ও সংবিধান আপনাকে এ অধিকার দেয়নি। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন কাউকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া আইনবহির্ভূত। কেউ অপরাধ করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন। কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে অন্য কেউ আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া মানে দেশের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়া। আর এমন কাজ এখন অনেক ঘটছে। এতে আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে। ফলে একসময় আমরা সবাই এই ধরনের নির্যাতন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবো। এখন তো একটি নির্দিষ্ট দলের নেতাকর্মীদের ওপর এই আক্রমণগুলো হচ্ছে। সামনে আস্তে আস্তে এটা সবদিকে ছড়িয়ে পড়বে। তখন কারও নিরাপত্তা থাকবে না। 

ঘটনা-১ ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি আকবর হোসেনকে আটক করে মারধরের পর পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। গত ২৬শে নভেম্বর উপজেলার মুক্তার বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আকবর হোসেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছোট ভাই ও দাগনভূঞা পৌরসভার সাবেক মেয়র। তবে ওই ঘটনায় হামলাকারীদের কারোর বিরুদ্ধেই মামলা হয়নি। উল্টো আকবরই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন। 

ঘটনা-২ চট্টগ্রামে নাশকতার অভিযোগে এক বিএনপি নেতাসহ দু’জনকে মারধর করে পুলিশে তুলে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ২০শে নভেম্বর সন্ধ্যায় ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ জাম্বুরি ফিল্ড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গ্রেপ্তার দু’জন হলেন নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মোস্তফা ও কর্মী মাঈনুদ্দীন মানিক।  এ ঘটনায় মিজানুরের পরিবার মামলা করতে গেলেও মামলা নেয়া হয়নি। 

ঘটনা-৩ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বাড়ি ফেরার পথে যুবদলের এক নেতাকে মারধরের পর ছুরিকাঘাত করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গত ২০শে নভেম্বর রাতে উপজেলার সাতকানিয়া বান্দরবান সড়কের কেরানীহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মোস্তাফিজুর রহমান উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। 

ঘটনা-৪ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীতে উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব মহিউদ্দিন ওরফে রাজুর ওপর হামলা চালায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ৫ই নভেম্বর সকাল সাতটার দিকে চৌমুহনী শহরের কালীতলা সড়কের মাথায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। পরে হামলাকারীরা গুরুতর আহত অবস্থায় মহিউদ্দিনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কারাগারে পাঠান। 

ঘটনা-৫ ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় মোশারফ হোসেন নামে এক যুবদল নেতাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আটক করে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা। গত ৫ই নভেম্বর দুপুরে উপজেলার ৩ নম্বর মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের দক্ষিণ মঙ্গলকান্দি এলাকায় তার শ্বশুরবাড়ি থেকে আটক করা হয়। মোশারফ ঢাকা উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের সহযোগী ও  ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য সচিব প্রার্থী ছিলেন। 

ঘটনা-৬ রাজধানীর ফার্মগেট ফুটওয়ার ব্রিজের নিচে হাতিরঝিল থানা বিএনপি’র আহ্বায়ক নাজমুল হক বাচ্চুকে ধাওয়া করে আটক করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। পরে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করেন। ছাত্রলীগের নেতারা হাসপাতালে পুলিশ ডেকে বাচ্চুকে ধরিয়ে দেন। গত ২৩শে নভেম্বর এ ঘটনা ঘটে। 

ঘটনা-৭ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনকে পিটিয়ে পুলিশের কাছে তুলে দেন ছাত্রলীগ। ২৮শে নভেম্বর রাতে রাজধানীর মগবাজারে এ ঘটনা ঘটে। এদিন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি খোকন গাজীপুর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সম্রাটসহ তার মগবাজার নয়াটোলার বাসায় যাওয়ার পথে মগবাজার মাজারের সামনে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী পথরোধ করে মারধর করেন। পরে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।

https://mzamin.com/news.php?news=86242