২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ২:৫৪

ভাসুরের নাম মুখে নিতে নেই

-মো: হারুন-অর-রশিদ

 

আমাদের দেশের মহাক্রমশালী নির্বাচন কমিশনাররা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে এখন খুবই ব্যস্ত সময় পার করছেন। শত ব্যস্ততার ফাঁকে মাঝে মধ্যে মিডিয়ার সামনে এসে কিছু কথা জনগণকে শোনাচ্ছেন। এই যেমন কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশনার মো: আনিছুর রহমান বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘তারা যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।’ বিএনপির নাম মুখে না নিয়েই ‘তারা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বিএনপিকে নির্বাচন কমিশনার সাহেব হয়তো ভাসুরের দৃষ্টিতে দেখেছেন। সে কারণে তিনি বিএনপির নাম মুখে নিতে একটু লজ্জাবোধই করেছিলেন। ‘তারা’ শব্দটি ব্যবহার করে একটু তাচ্ছিল্যও করলেন আবার ভাসুরের নাম মুখে না নিয়ে লজ্জার হাত থেকেও বাঁচলেন। প্রবাদে তো আছেই, ভাসুরের নাম মুখে নিতে নেই।

 

নিঃসন্দেহে বিএনপি দেশের সবচেয়ে বেশি জনগণের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল। সেই দলকে বাদ রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব আয়োজন করে চলেছে নির্বাচন কমিশন। একটি অবাধ, সুষ্ঠুু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এটি তো পরীক্ষিত সত্য যে, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ ব্যতীত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাদের আনুপাতিক হারও প্রায় কাছাকাছি। জনগণের বাকি ৩০ শতাংশ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থক। এই ৩০ শতাংশ সমর্থকের প্রায় ২০ শতাংশ বিএনপির প্রতি এবং ১০ শতাংশ আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে থাকে। বিএনপি এবং তার সাথের যোগসাজশ মিলে প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ দলীয় সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। কাজেই বর্তমানে যে নির্বাচনের আয়োজন চলছে, এটিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে না।

এবার নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানের আরেকটি যুক্তি খণ্ডন করছি। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত ৪৪টি রাজনৈতিক দল রয়েছে ‘শতভাগ দল কখনোই নির্বাচনে আসেনি এবং অংশ নেয়নি। যখন অধিকাংশ দল নির্বাচন করে, তখন নির্বাচনের একটি আমেজ চলে আসে। তিনি আহ্বান করে বলেছেন, সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক।’ বিএনপি নির্বাচনে না এলে এর প্রভাব পড়ার কোনো আশঙ্কা আছে কি না, এমন প্রশ্নে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘গণমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা উঠছে। ৭০ শতাংশ যদি হয়ে থাকে, যদিও নির্বাচন কমিশন কত শতাংশ, সেটি বিশ্লেষণ করেনি। যদি ৭০ শতাংশই অংশ নিয়ে থাকে, তবে নির্বাচনে প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই।’ অর্থাৎ তার ভাষ্য অনুযায়ী, বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও সমস্যা নেই। বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও নির্বাচন হয়ে যাবে কিন্তু ৫৫ শতাংশ মানুষ ভোট থেকে বঞ্চিত হবে। আবার যদি বিএনপি বর্তমান এই আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়, সে ক্ষেত্রেও ওই ৫৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে পারবে না। কারণ, হয় তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেবে না, নতুবা তাদের ভোট আগেই কোনো বিশেষ মার্কায় দেয়া হয়ে যাবে।

আমাদের নির্বাচন কমিশন সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপধারা অনুযায়ী, ‘দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং কেবলমাত্র সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।’ সংবিধানের লেখা আইনে নির্বাচন কমিশন বাঘ হলেও অপারেশনালি নির্বাচন কমিশন মোটেও বাঘও স্বাধীন নয়। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে দাঁতবিহীন বাঘ বলে অভিহিত করেছেন। সব দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার পরিবর্তে তারা কথার ফুলঝুরি দিয়ে সরকারকে খুশি রাখতে, শব্দ চয়নে কে কার থেকে বেশি এগিয়ে থাকবে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিভিন্ন সময় দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের চিন্তা আর নির্বাচন কমিশনের চিন্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অধিকাংশ নির্বাচন কমিশন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেনি। ২০১৪ সালে রাকিব উদ্দীন কমিশন, ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশন ও ২০২৩ সালে আউয়াল কমিশন সরকারের কাছে কে কতটুকু নতজানু তা দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। কাজেই হাঁকডাক যাই ছাড়–ক, নতজানু কমিশনের পক্ষে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন এখন রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে। সরকার একাই পরিচালক, অভিনেতা সব দায়িত্বই পালন করছে। নির্বাচন কমিশন শুধু মঞ্চ সাজানোর দায়িত্ব পালন করছে। সারা দেশ মিলে যাদের ১০ হাজারের বেশি ভোট নেই এমন কিছু দলকে নিবন্ধন দিয়ে অর্থাৎ কিংস পার্টি বানিয়ে তাদেরকে নির্বাচনে এনে নির্বাচন জায়েজ করার কূটকৌশল এই দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ কিভাবে নেবে তা হয়তো সময় হলে স্পষ্ট হবে। তবে, ইতিহাসে আওয়ামী লীগ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন বাকশাল ইতিহাসের গন্ধ থেকে আওয়ামী লীগ কোনো দিনই বের হয়ে আসতে পারবে না।

বৈশি^ক কারণে হোক আর দেশের দুর্নীতি, অপশাসন ইত্যাদির কারণে হোক- বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব সঙ্কটের মধ্যে আছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল রাখার জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকল্প নেই। কিন্তু তার পরিবর্তে রাজনীতিকে একব্যক্তিকেন্দ্রিক করার কারণে আমাদের অর্থনীতি এবং কূটনীতি যে আরো বড় একটি চাপের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, সেটি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। সেই চাপ সামাল দেয়ার জন্য যে জাতীয় ও রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং বিচক্ষণতা প্রয়োজন, তার কোনো নমুনাই দৃশ্যমান নেই; বরং রাজনৈতিক বিভক্তি সমাজকেও তীব্র মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমাদেরকে একটি গণতান্ত্রিক ভোট ব্যবস্থার জন্য রাজপথে জীবন দিতে হচ্ছে। সংগ্রাম করতে হচ্ছে, একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে, যেখানে রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তির যুদ্ধ হচ্ছে না। যুদ্ধ করতে হচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সাথে রাষ্ট্রের পুলিশ, প্রশাসন এবং সব ধরনের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে, এমন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে সেই যুদ্ধ বেশি দিন চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিন হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে বন্দী করা হচ্ছে। রাজপথে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলের কেউ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারছে না। এই ভীতিকর পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের জন্য মোটেও উপযোগী নয় দেশের পরিস্থিতি। ‘দেশে ৬৮টি জেলখানা আছে। তার ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৭০০। বর্তমানে তা বন্দীতে উপচে পড়ছে। সেপ্টেম্বরে বন্দীর সংখ্যা ছিল ৭৭ হাজার ২০০। এসব বন্দীদের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ হাজার হলো রাজবন্দী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার-বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া-বিষয়ক সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার ভয়েস অব আমেরিকাকে বেেলছেন, জানুয়ারিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদেরকে দিয়ে বাংলাদেশের জেলখানা দ্রুতই ভরে ফেলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (মানবজমিন, অনলাইন, ২৭ নভেম্বর-২০২৩)।’

ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে। রিপোর্টটির নাম দিয়েছে, বাংলাদেশে ‘অন্যায্য’ নির্বাচনের প্রস্তুতি। ২০২৪ সালের এই নির্বাচন প্রমাণ করবে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি। এই নির্বাচন এটিই নির্ধারণ করবে যে, দেশ কোন পথে যাবে- উত্তর কোরিয়া, কম্বোডিয়া, উগান্ডা, নিকারাগুয়ার মতো একদলীয় একটি রাষ্ট্র হবে নাকি গণতন্ত্রের পথে ফিরবে। তবে, ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশন নির্বাচন নিয়ে যে কারসাজির ছক এঁকেছে, তাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। যদি এমনটিই হয়, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক দুর্বিষহ দিন।

পরিশেষে, যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো- দেশের ১৮ কোটি মানুষকেই স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল স্পিরিট ধারণ করা উচিত। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কায়েমি স্বার্থ বাদ দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। কোনো দলের পূজারি হওয়ার প্রয়োজন নেই। দায়িত্বের প্রতি সততা ও দায়বদ্ধতা খুব বেশি প্রয়োজন। লোভ-লালসার কাছে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হওয়ার চেয়ে একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বুকে ধারণ করা অনেক বেশি গৌরবের। মনে রাখতে হবে, কাউকে ঠাকুর আর কাউকে ভাসুর বানিয়ে দেশ, জাতি, সমাজ, সভ্যতাকে ধ্বংস করার কাজে যারা জড়িত তাদের জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। পাপ মোচনের সুযোগ থাকবে না।
harun_980@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/795656