২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ২:৫২

দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ

ভারত কি বাংলাদেশেও মালদ্বীপের ভুল করছে?

এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা দুই দলের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল না। তবে ফাইনালের দিন ভারতের বিপক্ষে গলা ফাটাতে উৎসাহের কমতি ছিল না বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের মধ্যে। ১৯ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া যখন ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচ জিতেছিল, তখন বাংলাদেশে ছিল উৎসবের আমেজ। হাজার হাজার মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিপক্ষে স্লোগান দেয়। এমনকি ফেসবুকেও অনেকে মন্তব্য করেছেন যে, এই দিনটি তাদের জন্য ঈদের মতো লাগছে। ভারতীয় সংবাদপত্রে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ বাংলাদেশীদের ভারতের পরাজয় উদযাপন করার ভিডিও প্রকাশ করেছে, যা বাংলাদেশ ও ভারতে ভাইরাল হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব শুধু ভারতীয় ক্রিকেট দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশের মানুষ ক্রমশই ভারতবিরোধী হয়ে উঠছে। ভারতবিরোধী মনোভাবের এই ঘটনা বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন ধরেই দৃশ্যমান। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং মন্তব্য করেছিলেন যে- ‘২৫ শতাংশ বাংলাদেশী ভারতবিরোধী।’ বর্তমান পরিসংখ্যান নিয়ে কোনো জরিপ নেই।
যাইহোক, বাংলাদেশকে জানেন এমন যে কেউ স্বীকার করবেন যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতবিরোধী মনোভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ভারতের শাসক দল বিজেপি নেতাদের মুসলিমবিরোধী বক্তব্য অবশ্যই এর একটি প্রধান কারণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে ভারতের সমর্থন। দলটি বাংলাদেশে দু’টি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কোনো কর্মীর সাথে কথা বললে তারা বলে, আওয়ামী লীগ ১৫ বছর শাসন করতে পেরেছে শুধুমাত্র ভারতের মদদে। বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একটি বক্তব্যেও। সেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন করে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।’ এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে খুশি নয়।

ভারতের ‘বাংলাদেশ নীতি’- কি ভারত বিরোধী মনোভাবকে উসকে দিচ্ছে? এবং এটি কি এই অঞ্চলে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তার ক্ষতি করছে? ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা মালদ্বীপের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের নীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে পারেন। নির্বাচনের ফলাফল এবং মালদ্বীপে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক প্রমাণ করে যে, ভারতের প্রতিবেশী দেশের জনগণ তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপে নির্বাচনের পরপরই, নবনির্বাচিত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের প্রধান পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা একটি ভারতীয় নিউজ পোর্টালকে বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাই মালদ্বীপের প্রগ্রেসিভ পার্টির (পিপিএম) সেক্রেটারি মোহাম্মদ হুসেন শরীফ আশ্বস্ত করেন যে, দেশটির নতুন সরকার নয়াদিল্লির প্রতি শত্রুতা করবে এই ভেবে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। যদিও এক্সে দেখা গেছে, মালদ্বীপের যুবকদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হয়েছে। কেউ কেউ লিখেছেন যে, তারা নতুন সরকার থেকেও সমর্থন প্রত্যাহার করবে যদি তারা ভারতকে তার সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলতে ব্যর্থ হয়।

মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু তার দেশের ভারতবিরোধী মনোভাব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন এবং ক্ষমতায় বসার একদিন পরেই স্পষ্টভাবে তিনি ভারতের কাছে তার বার্তা পৌঁছে দেন। তিনি বলেন, প্রথম দিন থেকেই তিনি ভারতীয় সেনাদের অপসারণের চেষ্টা শুরু করবেন। ১৭ নভেম্বর শপথ নেয়ার পর তিনি তার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেন। মালদ্বীপে অল্প কিছু ভারতীয় সেনা অবস্থান করছেন। এই সংখ্যা আনুমানিক ৭৫ জন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই প্রযুক্তিবিদ এবং পাইলট। ভারতের দাবি, তাদের এই সামরিক উপস্থিতি মানবিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারপরও অনেক মালদ্বীপবাসী ভারতের এই দাবিকে বিশ্বাস করে না। তারা বিষয়টিকে তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।

মালদ্বীপের প্রগ্রেসিভ পার্টি (পিপিএম) এবং মুইজ্জুর পিপল্স ন্যাশনাল কংগ্রেস (পিএনসি) ‘ইন্ডিয়া আউট’- প্রচারণা চালিয়েছেন। এর আগে দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইবরাহিম সোলিহ, তিনি আবার ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। ইবরাহিম সোলিহ ভারতীয় বিনিয়োগ এবং সামরিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং মালদ্বীপে চীনা বিনিয়োগ ও কার্যক্রম অবরুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। যদিও ‘ইন্ডিয়া আউট’- প্রচারণার মূল উদ্দেশ্য ছিল মালদ্বীপে নয়াদিল্লির হস্তক্ষেপ সীমিত করা। তবে সোলিহ সরকারের প্রতি অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও এই প্রচারণা সমর্থন পেয়েছিল। সোলিহ আন্দোলনের ওপর একটি বিতর্কিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।

আর এখান থেকেই ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। মালদ্বীপের মানুষের এই ভারতবিরোধী মনোভাব আসলে তাদের সরকারবিরোধী মনোভাবের অংশ। বিরোধী দলগুলো একইসাথে ভারত-বিরোধী ও সরকারবিরোধী উভয় মনোভাবেই ইন্ধন জোগায়। যেহেতু ভারত এই দেশগুলোতে একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করছে, তাই এই সরকার বিরোধী মনোভাব ভারতবিরোধী মনোভাবে পরিণত হচ্ছে।

এটি আরো বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারতপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সহিংসতার পথ নেয়। বাংলাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে পুলিশি অভিযান, গণগ্রেফতার, বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে হামলা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকারকর্মীদের প্রায়ই গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং সাংবাদিকদের ভয় দেখানো হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি প্রতিবেদনে বলেছে, সরকার এবং তার সমর্থকরা শুধুমাত্র ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে ৫৬ জন সাংবাদিককে টার্গেট করেছে বলে জানা গেছে। এই হেনস্তা নিয়ে ভারতের নীরবতাকে সবথেকে ভালোভাবে দেখলেও ‘মৌন সম্মতি’- মনে হচ্ছে। আর খারাপভাবে দেখলে মনে হচ্ছে, ভারত এসব হেনস্তায় ‘শক্তিশালী সমর্থন’- দিচ্ছে।

ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোতে ভারতের প্রভাব গভীর। নয়াদিল্লি চাইলে হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাৎপসরণ নিয়ে আওয়ামী লীগকে জবাবদিহি করতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত ভারত মনে করছে যে, আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিলে তার স্বার্থসিদ্ধি করা যাবে। এমনও হতে পারে যে, ক্ষমতাসীন দল কোনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়াই আরো অনেক সময় ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে। তবে বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমর্থকরাতো আর কোথাও চলে যাচ্ছেন না। দমন-পীড়ন চালিয়ে বিএনপিকে বিলুপ্ত করা গেলেও বাংলাদেশে ভারতবিরোধী জনতা থেকেই যাবে। যে তরুণরা এখন ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে, ভবিষ্যতে তারা ভারতের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিতে পারে। বাংলাদেশে ক্রমশ অ-জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি সরকারকে সমর্থন এবং বাংলাদেশের বিরোধীদের দমনকে অনুমোদন ভারতের জন্য স্বল্প মেয়াদে লাভজনক হতে পারে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকদের এই নীতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/795782