২ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ২:৫১

শিক্ষার মান উন্নয়ন জরুরী

-অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন 

 

শুরু করছি দুটি প্রবাদ বাক্য দিয়ে- (কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই, বাইরে ফিটফাট- ভেতরে সদরঘাট)। এ দুটো প্রবাদ বাক্যের সাথে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে তুলনা করলে বাড়িয়ে বলা হবে না। শিক্ষার বিষয়বস্তু ও শিক্ষাদান পদ্ধতি বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন করে সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে, কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার মান উন্নয়ন করা। কিন্তু আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকের মতে এ কারিকুলাম শিক্ষাব্যবস্থাকে একবারে শেষ করে দেয়ার শামিল। নতুন এ কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর নাকি ক্ষতিকর তা সময়ই বলে দিবে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে বহু স্কুল, কলেজ- বিশ^বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি করা হয়েছে। কিন্তু কাংখিত মানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। মানব সভ্যতার মূল ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু এ শিক্ষা যখন বাণিজ্যে রূপ নেয় তখন সেখানে শিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না; বরং শিক্ষা নিয়ে ঢং করা হয়।

নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে প্রচুর লেখা পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত হচ্ছে। কেউ পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, কেউ বিপক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধে এ কারিকুলাম ভূমিকা রাখবে এমন আশাও কেউ কেউ করছেন। নিবন্ধের উদ্দেশ্য যেহেতু শিক্ষা কারিকুলাম নয় সেহেতু কারিকুলাম নিয়ে কথা না বাড়ানোই উত্তম। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার চিত্রটা তুলে ধরা। নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে যখন হৈচৈ চলছে ঠিক তখন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম দেখলাম- ইংরেজী বর্ণ চেনে না ১৭% শিক্ষার্থী (১৬ নভেম্বর ২০২৩ কালেন কন্ঠ) খবরটি দেখে আঁতকে উঠলাম। পুরো খবরটি পড়লাম। ভাবলাম এ ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করা প্রয়োজন। আমার বিশ^াস, এ খবরটি কাউকে না কাউকে হতাশ করেছে। বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশন শিক্ষার চিত্রটি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। সংস্থাটি সম্প্রতি রাজশাহী ও খুলনার প্রান্তিক অঞ্চলের ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১৫৩৩ জন শিশুর শিক্ষার ওপর জরিপ চালিয়েছে। জরিপের ফলাফল হতাশাজনক। আমরা যাদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, সে স্বপ্নের কান্ডারী, আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণ। তাদেরই একটি অংশ ১৭% শিক্ষার্থী ইংরেজি বর্ণ চেনে না। এটা হয়ত কারও কারও কাছে অবিশ^াস্য মনে হতে পারে! কিন্তু জরিপ বলছে একটি অংশ বাংলা ও ইংরেজি বর্ণ পর্যন্ত পড়তে পারে না। বেসরকারি জরিপের ব্যাপারে হয়ত কারও কারও এলার্জি হতে পারে। কিন্তু সরকারি জরিপেও দেখা গেছে যে, সারা দেশের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থী বর্ণমালা পর্যন্ত ভুলে গেছে, ১৬.৭৮ শতাংশ ছেলে ও ১৫.২২ শতাংশ মেয়ে ইংরেজি বর্ণমালা পড়তে পারে না। অর্থাৎ ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি বর্ণ চেনে না। ৮৪.৮৫ শতাংশ ছেলে ও ৮২.৮৬ শতাংশ মেয়ে ইংরেজি গল্প পড়তে পারে না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলা আমার মায়ের ভাষা। অথচ সে ভাষার বাংলা বর্ণ ২৮ শতাংশ ছেলে ও ৮.৭১ শতাংশ মেয়ে পড়তে পারেনি। এমনকি ৬১.৯৫ শতাংশ ছেলে ও ৫৩.১৪ শতাংশ মেয়ে বাংলায় গল্প পড়তে পারেনি। ১৪.১৯ শতাংশ ছেলে ও ১৩.০৬ শতাংশ মেয়ে গণিতের একক অঙ্ক শনাক্ত করতে পারেনি, ৯৫.৮৫ শতাংশ ছেলে ও ৯৭.২০ শতাংশ মেয়ে ভাগ করতে পারেনি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৯৫.৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কবিতা আবৃতি করতে পারে না। দুই সংখ্যার যোগ ও বিয়োগ করতে পারে না ৭৩.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। উপরোক্ত পরিসংখ্যানই আমাদের শিক্ষার চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখনই সাবধান হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের শিক্ষার মান দিন দিন বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়ছে না। শিক্ষার মান না বাড়ার পেছনে যতগুলো কারণ অন্তর্নিহিত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজনীতি। প্রতিহিংসার রাজনীতি বিরাজমান থাকায় গঠনমূলক সমালোচনাও করা যায় না। যারাই ক্ষমতায় থাকে তারাই ভিন্নমতের কথা সহ্য করতে পারে না। ফলে মানুষ সমালোচনা করতেও ভয় পায়। কারণ খতিয়ে দেখা হয় কে সরকারি দল আর কে বিরোধীদল। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের জিগির তুলছি। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করছি না। অথচ শিক্ষার মান উন্নত করতে না পারলে কোন অর্জনই ধোপে টিকবে না। শিক্ষার পরিবেশ কত চমৎকার ছিল। পাল্লা দিয়ে পড়ার আসর জমে উঠতো। আজকে যারা শিক্ষার্থী তারা হয়ত পাল্লা দিয়ে পড়ে না। অথচ সন্ধ্যার পর পাল্লা দিয়ে পড়ার একটা রেওয়াজ গ্রামে চালু ছিল। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর বিভিন্ন স্বর ভঙ্গিতে বই পড়ার তুমুল প্রতিযোগিতা দেখা যেত। কারও বাড়ীর পাশ দিয়ে যাতায়াত করার সময় পড়ার শব্দ শোনা যেত। দিনে রাতে পড়ালেখার প্রতিযোগিতা দেখা যেত। সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিও পড়ালেখা করতো। এখন পড়ার সংস্কৃতি প্রায় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। শিশু থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণীরা পড়ালেখা করবে-এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু তারা ভিনদেশীয় সংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। এ প্রবণতা রুখতে না পারলে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। ছেলেবেলায় কখনো সন্ধ্যার পরে কোন ছাত্রকে বাজারে ঘোরাঘুরি করতে দেখিনি। দেখলেই মুরুব্বিরা ধমক দিয়ে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিত। এখন ঘরে ঘরে সমাজ। ফলে কেউ কারও ছেলেকে ধমক দিতেও ভয় পায়। কারণ উল্টো যদি বলে আমার ছেলেকে আপনি শাসন করার কে? বড়দের সম্মান করার প্রথা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এখন গ্রামে রাত পর্যন্ত স্কুল পড়ুয়া ছেলেরা কখনো চায়ের দোকানে, কখনো রাস্তার মোড়ে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছে। মোবাইলে ব্যস্ত সময় পার করছে। পাব্জি, ফ্রী ফায়ার, টিকটক করে পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং তৈরি করছে।

প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করার মহাউৎসব লক্ষ্য করা যায়। কারণ পরিবর্তন হলেই পকেট ভারী হয়। এ সংস্কৃতি যতদিন চলবে ততদিন শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। আর একটি বিষয় ভাবা দরকার। এখন কিছু অভিভাবক যেনতেন উপায়ে সন্তানকে জিপিএ ফাইভ পাওয়ার লোভে অনৈতিক পথ বেছে নেয়। অথচ একটা সময় এমন ছিল যে, অভিভাবকেরা শিশু বয়সে সন্তানকে নীতি নৈতিকতা শিক্ষা দিত। ফজরের নামাযের পর সন্তানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিত, মসজিদে পাঠিয়ে দিত। আর এখন সকালে না উঠে শিশুরা ঘুমায়। কখন যে সকাল হয় তারা টেরও পায় না। নাস্তা খায় ১১টা থেকে ১২টায়। শিক্ষার অংশই ছিল খেলাধুলা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলা।

অথচ পড়াশুনার পাশাপাশি শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলাও জরুরী। আগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে হাডুডু, কাবাডি, নৌকাবাইচ, কানামাছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, বলি খেলা ও লাঠিখেলার আসর জমে উঠতো। এ সমস্ত খেলা দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে মানুষ দলে দলে খেলার মাঠে হাজির হয়ে যেত। গ্রামের শিশু-কিশোররা পড়াশোনার পাশাপাশি মেতে উঠতো বিভিন্ন ধরনের খেলায়। কিন্তু আমরা যান্ত্রিক জীবন যাপনে বেশি অভ্যস্ত হওয়ায় খেলাধুলা ও খেলার মাঠ উধাও। খেলার জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে স্মার্ট ফোন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব কোন খেলার মাঠও নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ ঘটছে না। যার কিছু নমুনা শহরের স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে দেখা যায়। শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি স্কুলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের বাড়তি যতœ নেয়ার ব্যবস্থা ও জনবল সংকট দূর করা প্রয়োজন। যেন শিক্ষা নিয়ে কেউ আর ঢং করতে না পারে। কারণ সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা। সুতরাং সভ্যতার স্বার্থে শিক্ষার মান বাড়ানো জরুরী।

 

https://www.dailysangram.info/post/542113