১ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ২:৩০

পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য এবং নানা প্রশ্ন

-ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ

 

গেল ২৫শে নভেম্বর, ২০২৩ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ভারত সফর করেন। সফরের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কোয়াত্রার সঙ্গে’ Foreign Office Consultation-এ তার  টিম নিয়ে অংশগ্রহণ, পাশাপাশি বাংলাদেশে যে সমস্ত দেশের কূটনৈতিক মিশন নেই, যারা ভারতে থেকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তাদের ধারণা দেয়া। কারণ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে এক ধরনের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। Foreign Office Consultation এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের রাতেই প্রায় ৫০টি দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হওয়া এবং তাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন সৃষ্টি করে যে, প্রথম অনুষ্ঠানটি কি তাহলে লোক দেখানো কিনা? সে যাই হোক, কূটনৈতিকদের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ হিসেবে আগাম মন্তব্য করেছেন এবং ভারতে অবস্থিত সকল কূটনৈতিকদের এ উৎসব দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন ‘আমি রাজনীতিক নই’। এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া কেউ কি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ হিসেবে দেখছে? একজন সাধারণ ব্যক্তির কাছে যদি আগামী নির্বাচন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে কেউ কি বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে আস্থার সঙ্গে বলতে পারবে আগামী নির্বাচন ‘গণতন্ত্রের উৎসব’? যেখানে ভোটের আধিক্যে বড় বিরোধী দল বিএনপি এবং বেশকিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করছে, সেখানে আগামী নির্বাচন কীভাবে গণতন্ত্রের উৎসব হতে পারে?

অধিকাংশ বিরোধী দল যেখানে নিরপেক্ষ তত্ত্ববধায়কের অধীনে নির্বাচন দাবি করছে, এ দাবিতে অনড় থেকে তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দিচ্ছে, তাদের দাবিকে তোয়াক্কা না করে গ্রেপ্তার, মামলা ও হামলার মাধ্যমে সরকারি দল ছাড়া অন্যদের জন্য যে ধরনের ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে, যা ক্রমাগত চলতেই থাকবে বলে ধারণা করা যায় সেখানে আগামী নির্বাচন কীভাবে ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ হয়? প্রশ্নটি আমার মতো এখন সবারই। প্রকৃতপক্ষে এটি গণতন্ত্রের উৎসব নয়, বরং সংবিধানের দোহাই দিয়ে  প্রহসনমূলক নির্বাচনী খেলার মহাউৎসব। জনাব মাসুদ বিন মোমেন কি প্রমাণ দিতে পারবেন বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনকে কেউ কখনো ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ বলে দাবি করেছেন? ধরা যাক, ২০১৪ সনের নির্বাচন, যেখানে বিনা ভোটে ১৫৩ আসনে নির্বাচনের নির্ধারিত তারিখের আগেই সরকারের দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচনের পরে সারা দেশের ভোট কেন্দ্রসমূহের যে চিত্র পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা দেখে কোনো বিবেকবান কি বলবেন এটি ‘গণতন্ত্রের উৎসব’ মুখর নির্বাচন ছিল? ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গে আসি। এই নির্বাচনে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশ্বাসের ভিত্তিতে বিএনপিসহ সকল দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

দুঃখের বিষয়, ওই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।

ভৌতিক ভোটে অধিকাংশ কেন্দ্রের ভোটের বাক্স দুপুরের মধ্যে পূর্ণ হয়েছে। এ তথ্যটি বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি অনস্বীকার্য সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ওই নির্বাচনে সরকারের অনুগত বিরোধীদলসমূহ ও হাত পাখা মার্কা ছাড়া বিএনপি প্রার্থী ও তার সমর্থকরা কোনো আসনেই নির্বিঘ্নে ভোটের প্রচারকার্য চালাতে পারেনি, সর্বত্রই সরকারি দলের হামলার শিকার হয়েছে নির্বাচনের প্রার্থী ও সমর্থকরা, মিথ্যা অভিযোগে পুলিশি গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। নির্বাচনের দিনে বিরোধী দলকে প্রায় সবগুলো আসনে পরিস্থিতির আলোকে নির্বাচন বয়কট করতে হয়েছে। এ সত্য আজ এদেশের সকল মানুষের জানা। এসবের আলোকে বৃহৎ বিরোধী দলবিহীন আগামী নির্বাচন যে গণতন্ত্রের উৎসব হবে একজন সরকারি আমলা হয়ে জনাব মাসুদ সাহেব কীভাবে নিশ্চয়তা দিতে পারেন?

সংলাপ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব মাসুদ বলেছেন ‘আমি রাজনীতিক নই, তবে মনে হয় সংলাপের সময় পেরিয়ে গেছে, এখন আর সংলাপের কোনো সম্ভবনা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি যা বলেছেন এ ধরনের বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের প্রথম সারির অনেক নেতাই দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেহেতু রাজনৈতিক প্রতিনিধি তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিলে মানায়। আমরা মনে করি একটি সমস্যাগ্রস্ত রাজনীতিক পরিস্থিতিতে কখনই সংলাপের সময় শেষ হয় না। কারণ দেশটি কোনো দলের একার নয়, রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চায় ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অধিকার প্রতিটি রাজনীতিক দল তথা সাধারণ মানুষের রয়েছে। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার মাধ্যমে কখনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না বরং গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়েছে। আগামীতেও তা ঘটতে যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান সকলেরই কাম্য।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

https://mzamin.com/news.php?news=86108