১ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ২:২৯

ডামি হবো কত দেবেন?

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

 

বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এক প্রকাশ্য প্রহসন শুরু হয়ে গেছে। এই প্রহসন মঞ্চস্থ করার জন্য বহুবিধ আয়োজন চলছে। এই তথাকথিত নির্বাচন হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ একতরফা। এই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবি জানিয়ে আসছে বিরোধীদলগুলো। সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, নির্বাচন ‘সংবিধান অনুযায়ী’ বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। গোটা পশ্চিমা বিশ^ও বলছে, নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক। কিন্তু সরকার তাদের অবস্থানে অনড়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো ধারা নেই। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তাক্ত সহিংস আন্দোলন করেছিল এবং তৎকালীন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল। সে অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন যে, তিনি সারা জীবনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পর অনুষ্ঠিত জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছিল।

পরবর্তী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, দুর্নীতি, দমনপীড়ন ও নির্যাতন এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, শাসক দল উপলব্ধি করেছিল যে, কোনো নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে নির্বাচন দিলে তাদের জেতার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রদ করার প্রতিজ্ঞা করেন তারা। কিন্তু ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি আবার ক্ষমতাসীন হয়। ফলে শেখ হাসিনার ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে কোনোদিনই তারা জয়লাভ করতে পারবে না। আর তাই বিষয়টি আদালতে তোলে। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন খায়রুল হক।

খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হিসাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিলেন। আর উল্লেখ করেছিলেন যে তা সত্ত্বেও পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে করা যেতে পারে। এ সম্পর্কিত মামলার রায়ের আগে আদালতের পক্ষ থেকে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করা হয়েছিলো। তাদের একজন বাদে সকলেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক সিনিয়র সদস্যরাও চেয়েছিলেন যে, আরো অন্তত দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল থাকুক। তখন তাদের মধ্যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ পরিলক্ষিত হয়েছিলো। কিন্তু শেখ হাসিনার চরম একগুয়েমির কারণে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে সামান্য সুযোগ তৈরি হয়েছিলো তা ধূলায় মিশে যায়। শুরু হয় আওয়ামী দুঃশাসনের কাল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা লোপ পায়। ২০০৯ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ও আনুকূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব হয়েছিলো নানা সমীকরণে।

কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়। বিশ্ব পরিস্থিতি ও উপমহাদেশে পরাশক্তিগুলোর নতুন মেরুকরণ হয়। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের অধীনে যে জালিয়াতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে আওয়ামী লীগ ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যায়। বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো সে নির্বাচন বর্জন করে। এমনকি হোসেন মুহম্মদ এরশাদও সে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। ফলে আওয়ামী লীগ এক তরফাভাবে নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। এরশাদকে বাগে আনার জন্য ভারত তাদের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে বাংলাদেশে পাঠায়। সুজাতা সিং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। সুজাতা এরশাদকে বলেন তিনি যদি নির্বাচনে অংশ না নেন, তাহলে নাকি বাংলাদেশে মৌলবাদীরা ক্ষমতায় চলে আসবে। এরশাদ তখন সুজাতাকে জানান যে, তার জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী থাকবে। তিনি তার দলের সদস্যদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার জন্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের চিঠি দেন নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু কোনো এক অলৌকিক হাতের কারসাজিতে সেসব প্রত্যাহারপত্র গায়েব করে দেওয়া হয়। এরশাদ কয়েকদিনের জন্য নিখোঁজ থাকেন। তারপর তাকে সিএমএইচ-এর একটি কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়। ঐ নির্বাচনে এরশাদ মনোনয়ন প্রত্যাহার নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। এরপর এরশাদকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টি থেকে বেশ কয়েকজনকে মন্ত্রী করা হয়। এরশাদের ক্ষোভ ছিল যে, আওয়ামী লীগকে তার দল সব সময় সমর্থন দিয়ে এলেও দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো কখনো প্রত্যাহার করে নেয়া হয়নি। প্রত্যাহারের আহ্বানেও সাড়া দেয়নি সরকার। এরপর দেশের জনগণের কাঁধে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে আওয়ামী লীগ। অপশাসন, দুঃশাসন, দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের ওপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালায় সরকার।

এরপর আসে ২০১৮ সালের নির্বাচন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় অনেক পণ্ডিত তাদের সমালোচনা করেছিল। বলেছিল ভুল করলো বিএনপি। তাই ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। সেখানে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারসাজিতে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। মাত্র ৭টি আসনে বিএনপিকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।

ইতোমধ্যে এরশাদ ইন্তিকাল করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান এরশাদের ভাই জিএম কাদের। এ নিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের মনোমালিন্য তৈরি হয়। জিএম কাদের অন্যান্য বিরোধী দলের সঙ্গে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। কিন্তু এবার ২০১৪ সালের মতো দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বাংলাদেশ প্রধান। এবারও জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধলে আওয়ামী লীগকে আসন ছাড়তে হবে। আবার ইনু-মেননের মতো খুচরা দলগুলোও ভিক্ষাপাত্র হতে দাঁড়িয়ে আছে। যদি এক একটা সিট ভাগে পাওয়া যায়। হালুয়া-রুটির আশায় কল্যাণ পার্টির জেনারেল ইব্রাহীমসহ বিএনপির অগুরুত্বপূর্ণ দুই-তিনজন ব্যক্তি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদেরকেও আসন ছাড়তে হবে।

আওয়ামী লীগ সাধারণত কেউ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। কিন্তু এবার আজীব নিয়ম চালু করেছেন শেখ হাসিনা, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এবারের নির্বাচনে কেউ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তো থাকবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও আওয়ামী লীগাররা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু তার জন্যও দলের অনুমতি লাগবে।

এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয় তা হলো টাকাওয়ালা প্রার্থীরা টাকা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বসিয়ে দেন। সে ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের মতো বিনাভোটের নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক সার্কাসের আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে। যে আওয়ামী লীগার নিশ্চত জানে যে, সে ডামি প্রার্থী। সে কেন অনার্থক টাকা-পয়সা খরচ করে নির্বাচন নির্বাচন খেলতে যাবে। অর্থাৎ দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের চিরস্থায়ী কবর রচনার আয়োজন সম্পন্ন করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী সরকার। যদিও সারা পৃথিবী বলছে, সত্যিকারের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সেটার ন্যূনতম সম্ভাবনারও কবর রচনা করেছে সরকার। কিন্তু এই পথে শেষ রক্ষা হবে তো?

https://www.dailysangram.info/post/542035