২৯ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:১৫

নির্বাচনে ডামি প্রার্থী

পুতুল পুতুল খেলা

 

প্রয়াত  কবি শামসুর  রাহমান লিখেছিলেন: উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে  স্বদেশ। সেই স্বদেশ অদ্ভুত এক নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে। এই নির্বাচনের ‘ভাইরাল ইস্যু এখন ডামি প্রার্থী। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রত্যেক আসনে ডামি প্রার্থী দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার ২০২৩ সালে এসে আমরা জানলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া একটা পাপ এবং তা দলীয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ! ডামি প্রার্থী দেয়া কী আইনত অপরাধ নয়? এর আগে আসুন ডামি প্রার্থী কি তা জেনে নেই। বাংলা অভিধানে ডামি অর্থ: কৃত্রিম, সাক্ষিগোপাল, মূর্তি, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর নকল যা আসল ব্যক্তি বা বস্তুর উপস্থিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে, সাক্ষিগোপাল, সাজানো, পুতুল ইত্যাদি। এই যে পুতুল পুতুল খেলা; ভোটারের সঙ্গে ছলনা!  তা কি শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? দেশের কোনো আইনে হয়তো সেটি সরাসরি অপরাধের শ্রেণিভুক্ত নয়। কিন্তু আইনের যে দর্শন, যে মর্মবাণী সেই দর্শন অনুসারে ভোটারের সঙ্গে প্রতারণা এবং জনগণকে  বিভ্রান্ত করা অবশ্যই একটি অপরাধ। 

 

দেশের এই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ডামি প্রার্থী দেয়ার নির্দেশনাই বলে দেয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও কেমন হবে? ইতিমধ্যে মানবাধিকার এবং অধিকার কর্মীরা এই নির্বাচনকে ‘নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। 
অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ভয়াবহ রূপ।

এই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে বিরোধী দল যাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকে সর্ব প্রথম তা নিশ্চিত করা হয়েছে। 
নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে মামলা, হামলা এবং গণগ্রেপ্তার করে প্রধান বিরোধী দলকে মাঠ ছাড়া করা হয়েছে। নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে দণ্ড দিয়ে বিএনপি’র নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বিএনপি চাইলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তিনি বলেন, এই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রধান প্রতিপক্ষকে মাঠ ছাড়া করা এবং তারা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে তা নিশ্চিত করা। অনেকেই এই পদ্ধতিকে কম্বোডিয়ার মডেল বলে অভিহিত করেছেন। আসুন একটু দেখে নেই কম্বোডিয়ার নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের মিল কতোটুকু। এ বছরের জুলাই মাসে কম্বোডিয়ার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচনে একচেটিয়া  জয় পায় হুন সেনের দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি)।
নির্বাচনের ঠিক আগে দেশটির জনগণের কাছে একমাত্র আস্থাভাজন বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে একপ্রকার নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল। আইনের ম্যারপ্যাঁচে ফেলে প্রধান বিরোধী দল ক্যান্ডেললাইট পার্টিকে নিষিদ্ধও করা হয়। নির্বাচনে  অংশ নিয়েছিল সিপিপিসহ ১৮টি রাজনৈতিক দল। যদিও কোনো দলেরই জনভিত্তি ছিল না। ১৭টি ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করা হয়। এই ১৭টি দল ছিল কার্যালয় সর্বস্ব। জনগণের মাঝে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এর আগের (২০১৮ সাল) নির্বাচনেও তারা একটি আসনও পায়নি। 

বিদেশে থাকা ১৭ জন বিরোধী রাজনীতিবিদকে  ২০ থেকে ২৫ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। নিজের তৈরি করা কিংস পার্টিকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে অভূতপূর্ব  শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করেছিলেন হুনসেন। নির্বাচনে কোথাও সহিংসতা হয়নি।  নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো দল প্রশ্ন তোলেনি। 

হুন সেনের সরকার কেবল প্রধান বিরোধী দলকে দমন করেই ক্ষান্ত হয়নি, সরকারের সমালোচক সব মুখও বন্ধ করে। সংবাদমাধ্যমেরও টুঁটি চেপে ধরে।  সরকার বেশ কয়েকটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং ডেটাবেইস সংস্থার ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়। তাদের  বিরুদ্ধে অভিযোগ-তারা জনমনে ‘বিভ্রান্তি’ ছড়াচ্ছে এবং ‘সরকারের মর্যাদাকে’ আক্রমণ করছে।

১২৫টি সংসদীয় আসনের নির্বাচনে হুন সেনের সিপিপি একাই পায়  ১২০টি আসন।
নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে সিপিপি পেয়েছে ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি হুন সেনের এই নির্বাচন। শুরু থেকেই অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বার্তা দিয়ে আসছিল  যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। 

একতরফা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দেশটিতে সহায়তা স্থগিত করে ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নস্যাৎ করার সঙ্গে’ জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কও ছিন্ন  করে যুক্তরাষ্ট্র। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন কম্বোডিয়ার পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। তারা বর্তমানের নির্বাচনী এই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বলে অভিহিত করেছেন। 

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরের দৃশ্যমান সকল নির্দেশক অনুযায়ী অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সকল সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নির্মূল প্রায় মন্তব্য করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংস্থাটি বলছে, নিয়ম রক্ষার নামে একতরফা নির্বাচন ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারে, গণতন্ত্র নয়; জনগণের আস্থাও নয়, ভোটাধিকারও নয়। একইভাবে সহিংসতা গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য অর্জনের পথ হতে পারে না।

জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে  নির্বাচন বলতে উপযুক্ত বিকল্প  থেকে যথাযথ প্রার্থীকে বাছাই করে নেতাকে বুঝায়। নির্বাচন হতে হবে খাঁটি, সেখানে  ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ  থাকতে হবে; ভয়ভীতিহীনভাবে যথাযথ প্রার্থীকে বেছে নেয়ার সুযোগ থাকতে হবে; নির্বাচনের পরিবেশ সকল রাজনৈতিক দলের জন্য সমান এবং নির্বাচনী প্রচার অভিযানে সকলের সমান সুযোগ নিশ্চিত হতে হবে; গণমাধ্যমের ভূমিকা হবে স্বাধীন এবং ভয়ভীতিহীন। কিন্তু নির্বাচনের যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তার  কোনো কিছুই বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কিংস পার্টি, ডামি প্রার্থী,  সরকারি জোটের মিত্র এবং দলছুট কতক লোক ছাড়া  সরকারি দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো উপযুক্ত দল  নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তবে কি বাংলাদেশ কম্বোডিয়ার পরিণতি ভোগ করবে?

https://mzamin.com/news.php?news=85792