২৯ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:১১

আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পরিণতি কখনোই শুভ হবেনা 

দেশী বিদেশী মতামতকে অগ্রাহ্য এবং চলমান উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের উদ্যোগ দেশকে আরো সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তারা অবিলম্বে একতরফা নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী দল নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও সংলাপের মাধ্যমে নতুন তফসিল দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। বিশিষ্টজনরা বলছেন, গণতন্ত্রের পূর্ব শর্ত হচ্ছে মানুষের ভোটের অধিকার, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক দল মানুষের এই ভোটের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত না করে আরেকটি ২০১৪ এবং ২০১৮ মার্কা নির্বাচনের আয়োজন করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে তাতে এর পরিণতি কখনোই শুভ হবে না বলে তারা মনে করছেন। 

সূত্র মতে, জাতীয় নির্বাচন প্রতি পাঁচ বছর পর পর আসে। সেটাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে উৎসবমুখর একটি পরিবেশের তৈরি হয়। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তথা সরকার সমান প্রচারণার সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু গত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার এবারও বিরোধীদল বিএনপি-জামায়াতসহ আন্দোলনকারী দলগুলোর সভা সমাবেশ করার সমস্ত অধিকার ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে কেবলমাত্র তাদের নিজেদের শিবিরের এবং পছন্দের দলগুলোকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করছে। অবস্থা এমন যে একটি দলের অফিসের সামনে উৎসবমুখর পরিবেশ আর অন্যদের দলের অফিসে ঝুলছে তালা। পুলিশের সতর্ক পাহারার কারণে সেখানে প্রবেশ করতে পারছে না কোন নেতাকর্মী। এমনকি সাধারণ মানুষও সেখানে অবস্থান করতে পারছে না। ইতিমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপির অর্ধশত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নতুন কৌশল হিসেবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে পারে বিএনপির এমন সব সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ঢালাও সাজা দেওয়া হচ্ছে আদালতকে ব্যবহার করে। এরই মধ্যে কমপক্ষে ৩০ নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আরও অর্ধশত নেতাকে সাজা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। 

একই অবস্থা দেশের অন্যতম বিরোধী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীরও। দলটির আমীর ডা. শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পরোয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খানসহ অনেকেই কারান্তরীণ। প্রতিদিন দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মামলা দিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কারাগারগুলোতে তার স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতার চার-পাঁচগুণ বেশি লোকজনকে রাখা হয়েছে। অনেকের বাড়িতে প্রতি রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হানা দিচ্ছে গ্রেফতার করার জন্য। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে গোটা দেশ আজ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।

বিশিষ্ট নাগরিকরা মনে করেন, সরকার এবং নির্বাচন কমিশন যে পথে হাঁটছে তাতে জনমনে এই ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে যে, দেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতোই আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর পরিণতি কখনোই দেশের জন্য ভালো হবে বলে মনে করেন না। তারা সরকারকে এই পথ পরিহার করে একটি সুন্দর সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং উৎসবমুখর নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য জনআকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তারা বলছেন, যেভাবে দলীয়করণের ফলে নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় প্রশাসন ও পুলিশ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে সেটির পুনরুদ্ধার করতে হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে আস্থার সংকট ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেটিকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পরের দুটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, এটিকে অমূলক বলে মনে করি না। ২০১৪ সালে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে বিরোধী দল ও জোট নির্বাচনে যাওয়ার পরেও ভোটার ও প্রার্থীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ অনুপস্থিত ছিল। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগেই ভোট হয়ে গেছে। অনেকের মতে, আগের রাতেই ভোট হয়ে গেছে। অর্থাৎ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এবারও তেমনটি হলে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে। একইসাথে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ ক্ষমতির সম্মুখীন হতে পারে। 

নির্বাচনব্যবস্থাকে একটি খোয়াড়ের মতো বানিয়ে ফেলা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, একটি খোয়াড়ের মতো বানিয়ে তাতে সবাইকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হচ্ছে, তোমরা ঠিক করো কোথায় বসবা, কিন্তু খোয়াড়ের বাইরে যেতে পারবে না। সেই খোয়াড় ভাঙতে হবে। 

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) বলেছেন, আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে। এই ডিসিকে দিয়েই আপনাকে নির্বাচন করাতে হবে। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কীভাবে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে দেখলাম একজন বৈধ প্রার্থীকে মারধর করা হয়েছে। কিন্তু ওই কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতেই বুঝা যায়, দ্বাদশ সংসদ নির্ভাচন কেমন হবে। 

স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্লজ্জভাবে, নিয়ম ভঙ্গ করে সরকারি কর্মকর্তারা একটি দলের পক্ষে ভোট চাইছেন। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ৩০ শতাংশ ইসির হাতে, বাকি ৭০ শতাংশই বিভিন্ন অংশীজনের কাছে। প্রশাসনের লোকজন যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছে তাতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

বিএনপির মুখপাত্র ও দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এবারও আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করতে চায়। তারা যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকতে বিরোধীদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে বিদেশে এই সরকার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সবাই বলছে, এদের অধীনে কখনোই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেনা। 

বিশিষ্টজনরা বলছেন, গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার শোভন পথ হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে হেঁটে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলা। অভীষ্টে পৌঁছার জন্য সব রাজনৈতিক দলেরই গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। থাকতে হয় গণরায় মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। ক্ষমতাসীনদের কথা বার্তায় যেটি মনে হচ্ছে তারা সরকারের থাকার বাইরে কিছুই যেন ভাবছে না। ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার অস্থিরতা তাদের সুস্থ চিন্তা করতে দিচ্ছে না। 

অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. আর এম দেবনাথ বলেন, রাজনৈতিক সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনৈতিক মন্দায় দেশ নিমজ্জিত হবে। এমনিতেই ডলার নেই, রেমিট্যান্স কম, আমদানি বাণিজ্য সংকুচিত, রাজস্ব আশানুরূপ নয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। অনেক সমস্যা। এসবের আরেকটি ফল আছে যা মারাত্মক। সেটি হচ্ছে শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ। আমরা যখন মন্দা নিয়ে চিন্তিত, মূল্যস্ফীতি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তখন ব্যাংকাররা ভাবছেন শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ নিয়ে। এমনিতেই এ সমস্যা চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ অবস্থায় যদি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে, হরতাল-অবরোধ চলতে থাকে, যদি সাপ্লাই চেইন বিঘিœত হয়-তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত আসবে না। অনেক ব্যবসায়ী এমনিতেই ঋণের টাকা ফেরত দেন না, তার ওপর যখন হরতাল-অবরোধের মতো ‘অজুহাত’ পাওয়া যাবে, তখন আর কোনো টাকাই ব্যাংকে ফেরত আসবে না। ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীরা তাদের ‘দুঃখের’ কথা বলতে শুরু করেছেন। এ অবস্থায় হরতাল-অবরোধে শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ যে আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। আর এটা হবে সর্বনাশা খবর।

চেয়ার প্রফেসর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই। আরেকটি কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, শর্তহীন সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য যে কথা বলে আসছে তিন দলকে, তাতে অনেক সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ‘সময় কম’। তো রাজনীতিতে তো স্বল্পসময় বলে কিছু নেই। যখন-তখন সিদ্ধান্ত হতে পারে, শেষ কথা বলে কিছু নেই। সংগত কারণেই তফশিল ঘোষণাকে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানিয়েছে, আবার বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে রাজনৈতিক সংকটের কোনোই সমাধান হয়নি। রাজনৈতিক সংকট জিইয়ে রেখে যদি নির্বাচনের তফশিল ঘোষিত হয়, সেই তফসিল অকার্যকর হতে বাধ্য। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হবে, সেই সরকারকেই কিন্তু এখনকার অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এ ছাড়া ২০২৬ সালে আমরা যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাব, তখন বড় ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে এবং সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য শুধু বাইরে নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ অনেকগুলো সংস্কার আমাদের করতে হবে। ওই ধরনের বড় ধরনের সংস্কার করতে গেলেও প্রধান অংশীদার যারা আছেন, অর্থাৎ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীদার যারা আছেন, তাদের মধ্যেও সহমর্মিতার প্রয়োজন হবে। কাজেই সেই চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে হলেও আমার ধারণা, এ নির্বাচন থেকেই সেই প্রক্রিয়াটা শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয় হবে। এর কারণ হলো, এখন যদি সহমতের ভিত্তিতে একটা সর্বজনগ্রাহ্য, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা না হয়, তাহলে এই রাজনৈতিক বিভাজনটা চলতেই থাকবে। রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের সংস্কার করাটা বেশ চ্যালেঞ্জের হতে পারে বলে আশঙ্কা করি। 

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন নিয়ে যদি জনগণকে এমন ভীতিকর অবস্থায় থাকতে হয়, তাহলে ভোটের দিন কী করা হতে পারে? এমন আলোচনা আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে আরও বেশি ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। তফসিলের ঘোষণার পরে একটি নির্দিষ্ট অংশের আনন্দ মিছিল করার ইতিহাস কি কোনো দেশে এর আগে ঘটেছিল? ভোটের তারিখ শুনে যদি এ ধরনের আনন্দ মিছিল করতেই হয় তবে তা দেশের সব নাগরিকের একসঙ্গে করার কথা। কেউ আনন্দ মিছিল করবে আবার কেউ পালিয়ে বেড়াবে, বিক্ষোভ করবে, এমন পরিস্থিতি কী জানান দেয়? 

https://www.dailysangram.info/post/541899