৮ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:২০

মন্ত্রিসভায় আজ উঠছে দুই আইনের খসড়া

ব্যাংকে জোরদার হবে ব্যক্তি ও পরিবারতন্ত্র

ব্যাংক পরিচালনা নিয়ে ‘ব্যাংক কম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০১৭’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উঠছে আজ। এটি হলে একটানা ৯ বছর একই ব্যক্তি বেসরকারি কোনো ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন। আর একটি ব্যাংকে একসঙ্গে চারজন পরিচালক হতে পারবেন একই পরিবার থেকে।

এটি হলে জনগণের আমানতের অর্থে পরিচালিত ব্যাংকগুলো প্রভাবশালী শেয়ারহোল্ডারদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মন্ত্রিসভার নীতিগত অনুমোদনের জন্য পাঠানো সংশোধিত খসড়া আইনে শেয়ারহোল্ডারদের বিপুল সুবিধা দেওয়া হলেও ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণপ্রক্রিয়া কঠোর করা হচ্ছে।
সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে ওই ঋণের জামিনদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও খেলাপি হবে। খেলাপি ঋণগ্রহীতা যেমন নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না, তেমনি খেলাপি ঋণের জামিনদারও নতুন ঋণ পাওয়ার অযোগ্য হবেন।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এ ধারার সমালোচনা করেছে। সংগঠনটির সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ গত ২৪ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, ‘প্রস্তাবিত এই ধারার কারণে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কম্পানি কোনো ঋণের জামিনদাতা হওয়ার অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে অনেক কম্পানিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, যা ব্যবসা প্রসারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। ব্যাংকিং খাতে নিরাপত্তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাবান্ধব করা। ’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান ব্যাংক কম্পানি আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী, একজন শেয়ারহোল্ডার সর্বোচ্চ একটানা দুই মেয়াদে ছয় বছর পরিচালক পদে থাকার সুযোগ পান। এরপর এক মেয়াদে তিন বছর বিরতি দিয়ে আবারও পরিচালক হতে পারেন। সে হিসাবে, গত ডিসেম্বরেই বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের প্রভাবশালী অনেক পরিচালকের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তবে তাঁরা এখনো পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেননি।
এদিকে গত ডিসেম্বরের আগেই বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির প্রভাবশালী পরিচালকরা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আজীবন পরিচালক পদে থাকার সুযোগ চান। তা না হলে অন্তত আরো তিন বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করেন তাঁরা। তাঁদের ওই দাবির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মতামত চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে আপত্তি করে। তা সত্ত্বেও প্রভাবশালীদের চাপে অর্থ মন্ত্রণালয় আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য আজ উত্থাপন করছে। এটি আইনে পরিণত হলে মেয়াদোত্তীর্ণ পরিচালকরা নতুন আইনের ক্ষমতাবলে আরো তিন বছর পরিচালক হিসেবে থাকার সুযোগ পাবেন।
বিদ্যমান আইনে একটি ব্যাংকে একই সঙ্গে এক পরিবারের দুজনের বেশি পরিচালক না রাখার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি না বাড়ানোর পক্ষে মত দিলেও সংশোধিত আইনে তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ একই সঙ্গে একটি ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হতে পারবেন। এতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিবারের প্রভাব বাড়বে এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
১৯৯৬ সালে সরকার গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটির সুপারিশে একই পরিবার থেকে একাধিক পরিচালক নিয়োগ না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। সংশোধিত আইনের খসড়া তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
বিদ্যমান আইনে পরিচালক নিয়োগের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। প্রভাবশালী ব্যাংক পরিচালকরা এটি প্রত্যাহারের দাবি তুলেছিলেন। তবে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, আগে বা পরে অনুমোদন নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি বা একই পরিবার থেকে দুজনের বদলে চারজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ দিলে ব্যাংকে একটি পরিবারের একচ্ছত্র প্রভাব তৈরি হবে। জনগণের আস্থার পরিচালনা পর্ষদ পাওয়া যাবে না। এতে আমানতকারীদের স্বার্থ বাধাগ্রস্ত হবে। ’
এদিকে সংশোধিত খসড়ার ৫(গগ) ধারায় ‘খেলাপি ঋণগ্রহীতা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘কোন দেনাদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যাহার নিজের বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত অগ্রিম, ঋণ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা বা উহার অংশ বা উহার উপর অর্জিত সুদ বা উহার মুনাফা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার ৬ মাস অতিবাহিত হইয়াছে। ’
ধারাটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘এই দফার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কোন ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমত প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক না হইলে অথবা উক্ত প্রতিষ্ঠানে তাহার বা উহার শেয়ারের অংশ ২০%-এর অধিক না হইলে অথবা উক্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণের জামিনদাতা না হইলে, উক্ত প্রতিষ্ঠান তাহার বা উহার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলিয়া গণ্য হইবে না। ’
এ বিষয়ে মাতলুব আহমাদ বলেছেন, সংজ্ঞায় ‘জামিনদাতা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করার কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসেবে জামিনদাতারা খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে গণ্য হবেন এবং তাঁদের নাম খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় লিপিবদ্ধ হবে এবং এসব জামিনদাতা তাঁদের অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও ব্যাংকিং লেনদেনে বাধার মুখে পড়বেন।
তবে জামিনদাতাদেরও খেলাপি ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি সমর্থন করে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘এটি ঠিক আছে। জামিনদাতাকে অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/05/08/494952