২৭ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ২:৫৩

দেওয়ানিতে জট

 

বিচার বিভাগের পুরো মনোযোগ এখন ফৌজদারি মামলার দিকে। তারিখ পড়ছে সপ্তাহের এ-মাথা ও-মাথা। সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তি-তর্ক-শুনানি চলছে রাত-দিন। সামনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এটিকে সামনে রেখে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তিতে ধুম পড়েছে আদালত পাড়ায়। বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, আদালত সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ত্রাহি দশা। সকালে সাক্ষ্য নেয়া শেষতো বিকেলে জেরা। বিশেষত, যারা রাজনৈতিক মামলার আসামি তাদের হাজির করা হচ্ছে সকাল-দুপুর-বিকেলে রুটিন করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন ধুন্ধমার ছোটাছুটি আদালত পাড়ায় সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। বিচার সংশ্লিষ্টরা সমস্ত মনোযোগ যেন ঢেলে দিয়েছেন ফৌজদারি মামলার ওপর। ঢাকা কোর্টে প্রতিদিনই থাকছে একাধিক রায়। বলা বাহুল্য, এসব রায়ে সাজা পাচ্ছেন কেবল সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীরা। গত দুই মাসে বিএনপি’র অন্তত ৪৭৮ জন (প্রায় ৫শ’) নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা, বিভাগ, জেলা এমনকি থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী। সাজা থেকে বাদ পড়ছে না বহু আগে মৃত আসামি, গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তি, প্রবাসী এমনকি শিশু পর্যন্ত। ফৌজদারি মামলার এই অস্বাভাবিক গতিকে অনেক আইনজীবী ‘সুপারসনিক গতি’ও বলছেন। মামলার এই গতিতে মুগ্ধ অনেক আইনজীবীকে বলতে শোনা যায়, আহা! মামলার এই গতি যদি সব মামলার ক্ষেত্রেই সবসময় থাকতো! তাহলে মামলা জট বহু আগেই ঠাঁই নিতো জাদুঘরে।

সরকারি পরিসংখ্যান মতে, দেশের আদালতগুলোতে বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। এর মধ্যে ৩৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫টি মামলা বিচারাধীন অধস্তন আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগে বিচারাধীন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫৪৭টি। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ পারিবারিক কোন্দল, হানাহানি, ধর্ষণ, খুন, লুটপাট, চুরি-ডাকাতি, হামলা, ভাঙচুর, নাশকতা, অগ্নিসংযোগ, বোমা হামলা, পুলিশের কাজে বাধা দান, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, জালিয়াতি, আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থপাচার, মানবপাচার, মাদক ব্যবসা, পাচার, ঘুষ, দুর্নীতির মামলা। আইনে যা ফৌজদারি অপরাধজনিত মামলা হিসেবে বিবেচিত। ফৌজদারি মামলার মধ্যেও শুধুমাত্র ‘নাশকতা’ ‘ভাঙচুর’ ‘হামলা’ ‘পুলিশের কাজে বাধাদান’ মামলার ‘বিচার’ চলছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। যেসব মামলার প্রায় সবগুলোই গত দেড় দশকে দায়ের হয়েছে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। যা ‘রাজনৈতিক মামলা’ হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক মামলার মধ্যে এখন সাজা দেয়া হচ্ছে বিশেষত: ২০০৯ সালে নির্বাচন পরবর্তী, ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালে নির্বাচন-পূর্ববর্তী মামলায়। বিএনপি’র দেয়া হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর ২৫ জুলাই পর্যন্ত বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা করা হয়। এসব মামলার আসামি ৪০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ৫০ থানায় ১৭ হাজার ৫৮৩টি মামলা রয়েছে। গত ৪ মাসে দায়ের হয়েছে অন্তত ১ হাজারের বেশি মামলা। এ মামলাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারবিরোধী আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের প্রয়োজনে। ২০০৯, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ‘বিচার’ চলছে ‘পুরনো মামলা নিষ্পত্তি’র উদ্যোগ স্বরূপ। সরকারের তরফ থেকে এ কথা স্বীকারও করা হয়েছে। চলতি বছর ২০ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক স্পষ্টতই বলেছেন, আমি প্রসিকিউশন বিভাগকে পুরনো মামলা আগে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে বলেছি। পুরনো মামলা নিষ্পত্তি করতে যেসব উদ্যোগ নেয়া দরকার তার সবই নেবে সরকার। এখানে আলাদা করে বিএনপি’র নেতাদের মামলা নিষ্পত্তির কোনো নির্দেশনা আমরা দিইনি। তার এ কথায় লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ‘পুরনো মামলা’ বলতে শুধু ফৌজদারি মামলাকেই বোঝানো হয়েছে। যুগ যুগ ধরে আদালতে ঝুলে থাকা লাখ লাখ দেওয়ানি মামলা ‘পুরনো মামলা’র সংজ্ঞায় পড়েনি। ফলে জমিজমা সংক্রান্ত মামলাগুলোর বর্তমান হাল-অবস্থা আলোচনায় আসছে না। যদিও দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আদালতের গঠন এবং কার্যাবলি আলাদা। একটি পর্যায় পর্যন্ত দুই ধরনের মামলার বিচারকও আলাদা। কিন্তু মামলাগুলো যখন অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতে যায় তখন ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার বিচারক হয়ে যান অভিন্ন। এ পর্যায়ে এদেশের বিচার ব্যবস্থায় একই বিচারক একসঙ্গে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। দুই মামলার জন্য আলাদা বিচারক থাকলেও কখনও কখনও একই এজলাসে পালাক্রমে বিচার কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে তাদের। একই বিচারক একাধিক বিষয়ে বিভিন্ন আদালত পরিচালনা করছেন। যথেষ্ট সময় না পাওয়ায় তার পক্ষে একটি মামলার সমাধানে আসা কঠিন। মামলার শুরু থেকে রায় প্রদান পর্যন্ত বহু বিচারকের পরিবর্তন ঘটে। দেওয়ানি মামলা জটের এটিও গুরুত্বপূর্ণ কারণ। গত অর্ধ-শতাব্দীতেও এই ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। যে কারণে রাজনৈতিক ফৌজদারি মামলার প্রতি অধিক মনোযোগের ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেওয়ানি মামলায়।

ঢাকা বারের অভিজ্ঞ আইনজীবী মিজানুর রহমান জানান, আদালতগুলো রাজনৈতিক মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেওয়ানি মামলায়। বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের মনোযোগ হারিয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ দেওয়ানি মামলা। সাধারণত, জমিজমা বন্টন, ওয়ারিশ, বেদখল, সম্পত্তির মালিকানা দাবি, নামজারি, শ্রেণি পরিবর্তন, অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পাওনাদি পরিশোধ ইত্যাদি বিষয়ে দেওয়ানি মামলা দায়ের হয়। দেওয়ানি মামলায় রয়েছে অন্তত ১৪টি ধাপ। সেরেস্তাদারের কাছে মামলা দায়ের, মামলা গ্রহণ ও নম্বর ইস্যু, বিবাদীকে সমন ইস্যু, বিবাদীর উপস্থিতি, লিখিত বিবৃতি দাখিল, মিডিয়েশন, ইস্যু গঠন, ৩০ ধারায় পদক্ষেপ গ্রহণ, এসডি, চূড়ান্ত শুনানি, অধিকতর শুনানি, যুক্তি-তর্ক, রায় প্রদান এবং ডিক্রি প্রস্তুতকরণ। এসবের প্রতিটি পর্যায়ে তারিখ পড়ছে ৬ মাস ১ বছর পর। ভূমি অফিস থেকে নথি তলব করা হলে তা যথা সময়ে আদালতে উপস্থাপিত হচ্ছে না। মামলার ছোট একটি সিদ্ধান্তের জন্যও আদালত কাটিয়ে দিচ্ছেন মাসের পর মাস। আইনজীবী জানান, রাজনৈতিক মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে আদালতে দেওয়ানি মামলায় বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের ভোগান্তি এবং ব্যয় বেড়ে গেছে। মামলা জট ধারণ করেছে অকল্পনীয় আকার।

আইন বিশ্লেষক মুহাম্মদ তাজুল ইসলামের মতে, আদি এখতিয়ারসম্পন্ন দেওয়ানি আদালতগুলোতে মামলা দায়ের, পরবর্তী পর্যায়ে মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিলম্বিত হচ্ছে। এর কারণ, মামলার সমন ও নোটিশ জারিতে অস্বাভাবিক কালক্ষেপণ। সমন জারি দেওয়ানি মামলার গতিশীলতার পূর্বশর্ত। অথচ দেশের আদালতগুলো সমন জারিতে অস্বাভাবিক সময় লাগাচ্ছে। এ কারণে কোনো একটি দেওয়ানি মামলা রুজুর পর ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক বছর লেগে যাচ্ছে।

মাস, বছর, যুগ-যুগান্তর পার হয়ে যায়- দেওয়ানি এবং অন্যান্য ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি হয় না। কেন নিষ্পত্তি হচ্ছে না- এ প্রশ্নের জবাবে বর্ষীয়ান আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, মানুষ সংবিধান অনুযায়ী দ্রুত ন্যায় বিচার পাচ্ছে কি না তার ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন। আমরা সব সময়ই বলে আসছি, যেভাবে এবং যে পদ্ধতিতে বিচারব্যবস্থা চলছে তা দিয়ে এ বিশাল মামলাজট নিরসন ও বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘব হবে না। বিচারকালীন ঘন ঘন শুনানি মুলতবির আবেদন ও তা মঞ্জুর বিচারের অন্তরায়। একবার শুনানি শুরু হলে কোনো মুলতবি ছাড়াই মামলা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলে বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘব হতে পারে।

রাজনৈতিক মামলার দ্রুত রায় প্রদানের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ বলেন, আমি শুনেছি, এসব মামলায় কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হচ্ছে না। পুলিশের সাক্ষ্য নিয়েই মামলার সাজা দেয়া হয়। এমনকি ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত বিচারিক স্তরগুলোও অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই তড়িঘড়ি করে বিএনপি নেতাদের সাজা দেয়া হয়েছে। একটি কথা হলো, দেশে ফৌজদারি মামলার বিচার শেষে দেখা যায় আসামিদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ২০ শতাংশ। আর ৮০ শতাংশ মামলাতেই আসামিরা খালাস পান। অথচ বিএনপি নেতাদের মামলায় ৯০ শতাংশ সাজা হচ্ছে। এটা একটি ইঙ্গিত বহন করে। বিচারে পুলিশ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে সাক্ষী হাজির করেছে। রায়েও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে- এটাই বিচার প্রত্যাশী মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো ফৌজদারি মামলা অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হতে দেখা যায়। আবার বছরের পর বছর শুনানির অপেক্ষায় পড়ে থাকছে মামলা। দেওয়ানি মামলায়তো এমনিতেই ধীর গতি।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক মামলার দিকে পুরো মনোযোগ নিবদ্ধ করায় শুধু দেওয়ানি মামলাই নয়- বরং ফৌজদারি অন্যান্য মামলাগুলোর কি পরিণতি হচ্ছে সেটি হচ্ছে প্রশ্ন। বিএনপি বগু আগে থেকে অভিযোগ করে আসছে যে, রাজনৈতিক মামলায় দ্রুত সাজা দিতে আইনমন্ত্রণালয় পৃথক সেল গঠন করেছে। পরবর্তীতে আমরা দেখলাম শত শত রাজনৈতিক মামলায় দ্রুত সাজা হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশের বিচারিক ইতিহাসে আমরা এমনটি দেখিনি।

ক্রিমিনাল মামলায় মূল জুরিসপ্রুডেন্টই হচ্ছে আসামির জেরা ও সাক্ষী। কিন্তু এখন যেটা দেখছি কয়েকজন পুলিশের সাক্ষ্য নিয়েই একতরফা দ্রুত রায় দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়ায় যারা সাজাপ্রাপ্ত হচ্ছেন তারাতো এই অভিযোগ তুলবে যে, তারা ন্যায় বিচার পাননি। সে ক্ষেত্রে তাদের অভিযোগটিতে ফেলে দেয়ার মতো নয়।

সিনিয়র এ আইনজীবী আরো বলেন, রাজনৈতিক মামলার কারণে দেওয়ানিসহ অন্যান্য ফৌজদারি মামলার বিচার পিছিয়ে পড়ছে। অনেক নিরপরাধ মানুষ বিনা বিচারে কারাভোগ করছেন। জামিনপ্রাপ্তরাও বছরের পর বছর মামলায় ঝুলে থাকছেন। এটিতো অন্যান্য সময়ের স্বাভাবিক বিচারিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যায় না।

https://dailyinqilab.com/national/article/619898