২৭ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ২:৪৪

অবরোধের প্রভাব সর্বত্র

 

বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা বিরোধীদলগুলোর টানা অবরোধ কর্মসূচির প্রভাব পড়ছে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে। বিশেষ করে শিক্ষা, গণপরিবহন, শপিংমল, ফুটপাথের ক্ষুদ্র ব্যবসায় এর প্রভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া যাতায়াতসহ সর্বত্র জনমনে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে এই সঙ্কট আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রথম ধাপের অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মিত ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এসব বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউআইইউ-এর ইইই বিভাগের শিক্ষার্থী সুমতাইয়া কবির নয়া দিগন্তকে বলেন, অবরোধ শুরুর পর থেকেই বাসায় অনলাইনে ক্লাস করছি। শুধু শুক্রবার-শনিবার ও যেদিন অবরোধ থাকে না সেই দিনগুলোতে সিটি টেস্ট ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলো নেয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষার্থীর বাবা নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রতিদিনই আমার সন্তানের ক্লাস থাকে, কোচিং থাকে। অবরোধের কারণে সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয় আমাদের।

গণপরিবহন মালিক ও কর্মচারীদের সাথে কথা হলে তারা অবরোধের কারণে চরম হতাশার কথা জানান। ঢাকা-বরগুনা রুটের মেঘনা পরিবহনের শাহ জামাল মিন্টু নামে এক কাউন্টার ইনচার্জের সাথে কথা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান। অবরোধের কারণে তারা এখন দিনের বেলা গাড়ি ছাড়েন না। শুক্রবার-শনিবার ও মাঝে মধ্যে রাতে দু’একটি গাড়ি ছাড়া হয়। এতে যেমন চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রীদের ঠিক তেমনি আয় কমেছে মালিক-শ্রমিকদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নোয়াখালীগামী তিশা পরিবহনের এক ড্রাইভার নয়া দিগন্তকে জানান, অবরোধের কারণে চরম অর্থ সঙ্কটে ভুগছেন তিনি। তিনি জানান, ট্রিপ চুক্তিতে তাদের বেতন হয়। গাড়ির চাকা ঘুরলে বেতন পান আর গাড়ি না চললে বেতন নেই। তাই দীর্ঘদিন অবরোধে গাড়ি বন্ধ থাকায় মালিক পক্ষের সাথে সাথে তাদেরও ক্ষতি হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে গুলিস্তানগামী স্বদেশ পরিবহনের ড্রাইভার দুলাল মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বাভাবিক সময় রাত সাড়ে ১১টায় গুলিস্তান থেকে আমরা সর্বশেষ গাড়িটি ছেড়ে যেতাম। কিন্তু অবরোধের কারণে বর্তমানে রাত সাড়ে ৭টায় সর্বশেষ গাড়ি ছাড়া হয়।

রাজধানীর রায়েরবাগ থেকে হিমালয় পরিবহনে করে গুলিস্তান আসা ফরিদ জোমাদ্দার নামে এক যাত্রী বলেন, আগে নির্দিষ্ট সময় গাড়ি পাওয়া যেত। অবরোধের কারণে গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় গাড়ি পেতে যেমন দেরি হচ্ছে ঠিক তেমনি যাত্রীর অভাবে প্রতিটা স্টেশনে গাড়ি অতিরিক্ত সময় অপেক্ষা করছে।

অবরোধের কারণে রাজধানীর শপিংমল ও ফুটপাথের মার্কেটগুলোতে ক্রেতা কমেছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। গতকাল রোববার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার শপিংমল ও ফুটপাথ ব্যাবসায়ীদের সাথে কথা হলে তারা নয়া দিগন্তকে জানান, অবরোধের কারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক ক্রেতা কমেছে। এ অবস্থার দ্রুত সমাধান না হলে তাদের বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে।
পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত পরিবহন শ্রমিকরা অবরোধের কারণে চরম ভয় ও আতঙ্কের কথা জানান। তারা বলেন, এত দীর্ঘ সময় অবরোধ আমাদের জন্য একটা মানসিক অশান্তি। প্রতিদিন আমরা যখন গাড়ি নিয়ে বের হই তখন আমাদের মাঝে একটা ভয় ও আতঙ্ক কাজ করে।

অবরোধের প্রভাবমুক্ত নয় প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারাও। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে পৌঁছাতে ও দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে আসা প্রবাসী যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। রাজধানীতে অবস্থিত রিক্রুটিং এজেন্সি ও প্রবাসী যাত্রীদের সাথে কথা বলে এমনটাই জানা যায়।

পুরানা পল্টনে অবস্থিত রিক্রুটিং এজেন্সি ধানসিঁড়ি ওভারসিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গোলাম আযম সৈকত নয়া দিগন্তকে বলেন, অবরোধের কারণে বিদেশগামী যাত্রীরা নির্দষ্ট সময় আসতে পারছে না। ইতোমধ্যে আমার কয়েকজন যাত্রী ফ্লাইট মিস করেছেন। অনেকে অবরোধের পর ফ্লাইট দেয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। সবমিলিয়ে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমি মনে করি সরকার ও বিরোধীরা উভয়পক্ষ বসে এ সঙ্কটের একটা সমাধানে আসা উচিত। তা না হলে দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জনগণের কথা চিন্তা করে তাদের একটা সমাধানে আসা উচিত।

জনসাধারণের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চান। সরকার ও বিরোধীদলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা এই সঙ্কটের অবসান চান। বর্তমান সমস্যার অবসান না হলে দেশ এক চরম ক্রান্তিকালে পতিত হবে বলেও মনে করেন তারা।

উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় সমাবেশ থেকেই ২৯ অক্টোবর সকাল-সন্ধা হরতাল ঘোষণা করে দলটি। একই দিনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি বিরোধী সমমনা দল হরতালের ঘোষণা দেয়। যেসব দল হরতালের ঘোষণা দেয়নি তারাও বিএনপি-জামায়াতের হরতালে সমর্থন দিয়ে মাঠে ছিল। এরপর ৩০ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী সব দলগুলো ৩১ অক্টোবর, ১ নভেম্বর ও ২ নভেম্বর টানা ৭২ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয়। এরপর থেকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধীদলগুলোর নিয়মিত টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/794574