৮ মে ২০১৭, সোমবার, ৮:১৮

প্রকল্পে প্রকল্পে সংঘর্ষ!

ঢাকার যানজট নিরসন ও সম্প্রসারণশীল ঢাকার প্রয়োজনে গৃহীত পরিবহন মহাপরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে এলোমেলো প্রকল্প গ্রহণের জন্য। সরকারি সংস্থাগুলোই লঙ্ঘন করছে 'সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা'-আরএসটিপি। এ পরিকল্পনায় না থাকলেও রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল (চুনকুটিয়া) পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে চায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। অতিরিক্ত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনুমোদন দিয়েছে 'ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ'-ডিটিসিএ। অন্য সরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা আপত্তি করছেন এ জন্য যে, ফ্লাইওভারটি মহাপরিকল্পনাভুক্ত প্রকল্প 'বাস র্যাপিড ট্রানজিট'-বিআরটি ও মেট্রোরেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এরূপ সমন্বয়হীন প্রকল্প গ্রহণের জন্য এর আগে বিশ্বব্যাংক বিআরটির একটি অংশের ঋণ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।


রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য আরএসটিপি নামের মহাপরিকল্পনা গত বছরের আগস্টে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। বলা হয়েছিল, আরএসটিপিভুক্ত এলাকায় আর কোনো প্রকল্প নেওয়া যাবে না। ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদের চার ধাপে মোট ২০ বছরে বাস্তবায়ন করা হবে পরিকল্পনাটি। ব্যয় হবে দুই লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। আরএসটিপিতে আছে, পাঁচটি মেট্রোরেল রুট (এমআরটি), দুটি বিনা বাধায় বাস চলাচলের পৃথক লেন (বিআরটি), তিনটি বৃত্তাকার পথ এবং ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে। এতে ফকিরাপুল থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল না; বরং ভবিষ্যতের আবাসিক এলাকা ঝিলমিল পর্যন্ত বাস চলাচল সহজ ও অবাধ করতে বিআরটি এবং একটি মেট্রোরেলের রুট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।


কিন্তু এ পথেই ফ্লাইওভার তৈরি করতে চায় রাজউক। বিআরটি-৩ প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ২০১৩ সালে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরবর্তী চার বছরে রাজউকের ফ্লাইওভার প্রকল্পটি অনুমোদন পায়নি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে গত ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ডিটিসিএর পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তারই মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজউক ফ্লাইওভারটি বাস্তবায়ন করবে। একই সভায় ডিটিসিএর অনুমোদন পায় গাবতলী-নবীনগর এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। এ প্রকল্পও মহাপরিকল্পনাবহির্ভূত।


গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সমকালকে বলেন, 'যদি মহাপরিকল্পনার বাইরে থেকে প্রকল্প নেওয়া হয়, তাহলে আরএসটিপি প্রণয়নের প্রয়োজন কী ছিল? মহাপরিকল্পনায় তো বলা আছে, আগামী ২০ বছরে ঢাকার যানজট নিরসনে কী কী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। সেখানে তো ফ্লাইওভার নির্মাণের কথা নেই। ফ্লাইওভারে যানজট দূর হয় না।' ফ্লাইওভার নির্মাণ রাজউকের কাজ কি-না, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।


রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ পথেই আরামবাগ থেকে ফকিরাপুল মোড়, বিজয়নগর, পল্টন, গুলিস্তান, নয়াবাজার, বাবুবাজার সেতু, কদমতলী হয়ে চুনকুটিয়া পর্যন্ত নয় কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। বাবুবাজারে বিদ্যমান সেতুর ওপর নির্মাণ করা হবে 'এক্সট্রাডোজড কেবল স্টেড ব্রিজ'।


গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ, বিআরটি-৩-এর কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। গত বছরের ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে বিআরটি-৩ নর্থ ফেইজের (গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর) কাজ চলছে। অর্থাভাবে শুরু করা হচ্ছে না সাউথ ফেইজের (বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল) কাজ। রাজউকের ফ্লাইওভারটি এ অংশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক- এ অভিযোগেই ২০১৫ সালে বিআরটির বিমানবন্দর সড়ক থেকে কেরানীগঞ্জ অংশে ঋণ প্রস্তাব বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক।


জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় আরএসটিপি প্রণয়ন করা হয়। এটি মূলত ২০০৪ সালে প্রণীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) সংশোধিত রূপ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান বলেন, 'এসটিপি ছিল গণপরিবহনবান্ধব। কিন্তু বাস্তবায়নের বেলায় ফ্লাইওভার, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রাইভেট গাড়িবান্ধব প্রকল্পকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে এসটিপি ভেস্তে যায়। ফলে সংশোধন করে আরএসটিপি প্রণয়ন করতে হয়। এখন যদি আবারও মহাপরিকল্পনাবহির্ভূত প্রকল্পগুলোকে ডিটিসিএ অনুমোদন দেয়, তবে আরএসটিপিও কোনো কাজে আসবে না, ভেস্তে যাবে।'


আরএসপিটিভুক্ত এলাকায় যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে ডিটিসিএর অনুমোদন নিতে হয়। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আহমেদ সমকালকে বলেন, 'মহাপরিকল্পনায় মেট্রো রেল ও বিআরটি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। ফ্লাইওভারের কথা নেই; কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনা করে পরিচালনা পর্ষদ সর্বসম্মতিক্রমে ফকিরাপুল রাউজক ফ্লাইওভার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।' সার্বিক দিক বলতে কী বোঝায় তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দেননি।


রাজধানীতে যানজটের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ভালো গণপরিবহনের অভাব ও প্রাইভেটকারের সংখ্যাধিক্য। ফ্লাইওভারে মূলত চলাচল করে প্রাইভেট কার। মহাপরিকল্পনায় আগামী ২০ বছরে গণপরিবহনবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকলেও ফ্লাইওভার কেন অনুমোদন পাচ্ছে- এর জবাবে নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'প্রাইভেটকার কমানো ছাড়া যানজট কমানোর কোনো উপায় নেই। তার পরও যাচাই-বাছাই করে পরিচালনা পর্ষদের মনে হয়েছে, ফ্লাইওভারটি গণপরিবহনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, তাই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।'


সভার নথি থেকে জানা যায়, প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার প্রকল্পটি অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না, তা খতিয়ে দেখতে পরামর্শ দেওয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে গণপূর্তমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, কদমতলীতে বিআরটি-৩ স্টেশন থাকবে, তা প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার প্রকল্পে বিবেচনায় রাখা হয়নি। বিষয়টি আরও যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সেনাবাহিনী। কদমতলীতে এর একটি ইন্টারসেকশন থাকবে। এ কারণে সেনাবাহিনীর মতামত চাওয়া হয়।


গত বছর ১৪ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ফ্লাইওভার প্রকল্পের বিষয়ে আপত্তি আসে। ফ্লাইওভারের নির্মাণ এলাকা এবং একই এলাকার অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়ের জন্যই ওই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যপত্র থেকে জানা যায়, ফ্লাইওভারের বিষয়ে আপত্তি জানান বিআরটি-৩-এর প্রকল্প পরিচালক। বিআরটির জন্য জায়গা রাখা প্রয়োজন, নয়তো ভবিষ্যতে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। রাজউকের দাবি, বিআরটির জন্য জায়গা রেখেই ফ্লাইওভার হবে। একই পথে নির্মাণ করা হবে, গাজীপুর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত মেট্রো রেল (এমআরটি-১)। ওই সভায় বলা হয়, এমআরটি-১ মাটির নিচেই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ফ্লাইওভারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না; কিন্তু মাটির ওপর (এলিভেটেড) হলে কী হবে, তার জবাব নেই।

http://bangla.samakal.net/2017/05/08/291095#sthash.htX5SjES.dpuf