২৬ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:১৯

ব্যয় বাড়লেও পরিশোধন কম

 

দেশের নগর ও পৌর এলাকাগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর ব্যয় বাড়ছে। দেখা গেছে, তিন অর্থবছরে গড়ে ব্যয় বেড়েছে ১৩.২ শতাংশ। সে তুলনায় মানসম্মত পরিশোধন নেই। বিশেষ করে কঠিন বর্জ্যের ক্ষেত্রে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘মিউনিসিপ্যাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট জরিপ ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন ও ৩২৮টি পৌরসভার ওপর জরিপ চালিয়ে এসব তথ্য দিয়েছে বিবিএস।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে তা যেমন পরিবেশের ক্ষতি করে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকিস্বরূপ। এ ক্ষেত্রে সমাধানে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার উপযোগী (রিসাইকল) করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তাঁরা।

বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এই ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার ২৬০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় হয় দুই হাজার ১১৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই খাতে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো ব্যয় করেছে এক হাজার ৮৭২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

বিবিএসের তথ্য মতে, এসব শহরে এখন চার কোটি পাঁচ লাখ মানুষের বাস। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য দৈনন্দিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন প্রতিবছর এ খাতে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪০টি পৌর ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পেছনে মাথাপিছু ব্যয় হয়েছে গড়ে ৫৫৮ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় হয় ৫৩৯ টাকা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় ৪৯৪ টাকা। অর্থাৎ ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত মাথাপিছু গড় ব্যয় ১৩.২ শতাংশ বেড়েছে।

জরিপে বলা হয়, ৩৪০ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে মোট জনবল রয়েছে ২০ হাজার ১০৫ জন, যার ৩৮ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

বিবিএসের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি টন বর্জ্যের গড় ল্যান্ডফিল পরিচালন ব্যয় ছিল দুই হাজার ৯৮৬ টাকা, যা পরের অর্থবছরে তিন হাজার ৯৩৭ টাকায় পৌঁঁছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি টন বর্জ্যে গড় ল্যান্ডফিল পরিচালন ব্যয় সামান্য কমে তিন হাজার ৮৪৯ টাকায় দাঁড়ায়। তবে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় কঠিন বর্জ্যের উৎপাদন কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কঠিন বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ তিন হাজার ৬২৭ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৮৩৯ টনে নেমে আসে।

মাথাপিছু বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণও কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাথাপিছু দৈনিক বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫৮০ গ্রাম, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০০ গ্রামে নেমে আসে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো গড়ে ৭৮ থেকে ৭৯ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রহ করেছে।

কঠিন বর্জ্য পরিশোধন কম

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে কঠিন বর্জ্যের শোধনের পরিমাণ নেই বললেই চলে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলো মোট কঠিন বর্জ্যের ১.০৪ শতাংশ পরিশোধন করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১.২৮ শতাংশ পরিশোধন করেছে ও ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ছিল ১.৩৬ শতাংশ, যা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম বলে মনে করছে বিবিএস।

পরিবার থেকে বেশি বর্জ্য

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হয়, এর প্রায় ৭০ শতাংশ আসে পরিবারগুলো থেকে। শহরগুলোতে শিল্প বর্জ্যের পরিমাণ কিছুটা কমেছে।

জরিপে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট কঠিন বর্জ্যের ১১.৪২ শতাংশ আসে শিল্প থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বর্জ্যের ১০.৯৮ শতাংশ ছিল শিল্পের।

চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবিএস বলছে, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মকর্তাদের ধারণা অনুযায়ী মানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নেতিবাচক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল জনসচেতনতা, অপর্যাপ্ত ল্যান্ডফিল্ড ও অপর্যাপ্ত বাজেট। পাশাপাশি রয়েছে সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য অপর্যাপ্ত অবকাঠামো।

বিবিএস বলছে, দেশে বিদ্যমান পদ্ধতি বিপুল পরিমাণ বর্জ্যকে কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনায় অক্ষম। এতে বেশির ভাগ বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা হয় না। বরং তা পরিবেশদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।

সুপারিশ হিসেবে বিবিএস প্রথমেই জনসচেতনতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলেছে। পাশাপাশি তারা স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইকলকে গুরুত্ব দিয়েছে। যেসব জৈব বর্জ্য রয়েছে, সেগুলোকে জৈব সারে রূপান্তরে জোর দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে বর্জ্য বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বাড়লে বর্জ্য বাড়বে। এসব বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতি করছে কঠিন বর্জ্য। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিক।’

বেনজির আহমেদ বলেন, বুড়িগঙ্গার তলদেশ কঠিন বর্জ্যে ভরে গেছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। এ ছাড়া মাতুয়াইলসহ রাজধানীর যেসব স্থানে খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে, তা নানাভাবে ক্ষতি করছে জনস্বাস্থ্যের। আবার কঠিন বর্জ্যে বাসা বাঁধছে এডিস মশা।

বেনজির আহমেদ পরামর্শ দিয়েছেন, এখন আমাদের রিসাইকলের দিকে যেতে হবে। এটি ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এটি একদিকে যেমন বর্জ্য কমাবে, অন্যদিকে পানি ও জলাধারগুলোকে রক্ষা করবে।

 

 

 

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/11/26/1339799