২৬ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৯:১৪

সরকারি টাকায় নির্মিত স্থাপনায় নিজের নাম জুড়ে দেন সংসদ সদস্য আবু জাহির

 

 

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার দারুচ্ছুন্নাৎ কামিল মাদ্রাসায় চারতলাবিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবনের উদ্বোধন হয় ৮ নভেম্বর। ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এ ভবনটি নির্মাণ করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)। প্রকল্পে ভবনটির কোনো নামকরণ না থাকলেও এটি উদ্বোধনের সময় হবিগঞ্জ-৩ (সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবু জাহিরের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু হবিগঞ্জ দারুচ্ছুন্নাৎ কামিল মাদ্রাসাই নয়; বরং সরকারি অর্থায়নে আরও পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মিত বহুতল ভবনের নামকরণ আবু জাহিরের নামে করা হয়েছে। স্থাপনাগুলো হলো, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের পাঁচতলাবিশিষ্ট ছাত্রাবাস, হবিগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে চার তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার শায়েস্তাগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের তিনতলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন, শায়েস্তাগঞ্জ ইসলামি একাডেমি অ্যান্ড হাইস্কুলের চার তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন এবং শায়েস্তাগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে চার তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন। এগুলোও ইইডি নির্মাণ করেছে। এই পাঁচটি ভবন নির্মাণে সরকারের প্রায় ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। এসব ভবন ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়।

যোগাযোগ করলে ইইডি হবিগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মিত ভবনগুলোর প্রকল্প-নামে কোনো ব্যক্তির নাম যুক্ত ছিল না। ইইডি কেবল ভবনগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে কারও নাম ভবনে যুক্ত হয়েছে কি না, সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। এটা আমাদের জানা নেই।’

এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মিত ভবনগুলোর প্রকল্প-নামে কোনো ব্যক্তির নাম যুক্ত ছিল না। ইইডি কেবল ভবনগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে কারও নাম ভবনে যুক্ত হয়েছে কি না, সেটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। এটা আমাদের জানা নেই।

আরিফুল ইসলাম খান, নির্বাহী প্রকৌশলী, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) হবিগঞ্জ

শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভা ২০১৬ সালে শায়েস্তাগঞ্জ মডেল কামিল এমএ মাদ্রাসায় এক তলাবিশিষ্ট একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করে দিয়েছে। এ ছাত্রাবাসের নামকরণও করা হয়েছে আবু জাহিরের নামে। এ ছাড়া শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালে কলেজে দুই তলাবিশিষ্ট মিলনায়তন কাম একাডেমিক ভবন নির্মাণ করে। এটির নামকরণও আবু জাহিরের নামে করা হয়। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ সালে হবিগঞ্জ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়। এ ভবন সংসদ সদস্যের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী আলেয়া আক্তারের যৌথ নামে নামকরণ করা হয়।

সদর উপজেলার জালালাবাদ গ্রামের একজন বাসিন্দা জানান, গ্রামবাসীর যৌথ মালিকানার একটা জায়গা ছিল। ২০১১ সালে আবু জাহিরের পরামর্শে জায়গাটি গ্রামের সবাই কলেজ নির্মাণের জন্য দান করেন। পরবর্তী সময়ে কলেজে জেলা পরিষদ দোতলা একাডেমিক ভবন, কমন রুম কাম গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে দেয়। গ্রামের নামে এ কলেজের নামকরণ হবে বলে এলাকাবাসীর প্রত্যাশাও ছিল। কিন্তু প্রভাব খাঁটিয়ে সংসদ সদস্য কলেজটি তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর নামে নামকরণ করিয়ে নেন।

তবে আবু জাহির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘জালালাবাদ গ্রামে আমিই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছি। গ্রামবাসীর সিদ্ধান্ত কলেজটি আমার নামে দিতে হবে। আর প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ভবনগুলোর নামকরণ করেছে। ম্যানেজিং কমিটি খুশি হয়ে এসব নামকরণ করেছে।’

আবু জাহিরের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও রয়েছে। নাগরিক সমাজের দুজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের পর থেকে হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের কমিটি প্রতিবছর সংসদ সদস্য জাহিরের  নির্দেশনায় গঠিত হয়। সম্প্রতি তাঁর আস্থাভাজন একজন ব্যবসায়ী নেতাকে হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি বানানোর জন্য তৎপর ছিলেন। এ অবস্থায় চেম্বার এখন দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

এ ছাড়া ২০২১ সালে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জাহিরের ভাই বদরুল আলম। জেলা আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ সংসদ সদস্যের অনুসারীদের হাতে রয়েছে বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে।

পেশাজীবী সংগঠনগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আবু জাহির বলেন, ‘বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।’ প্রেসক্লাবের কমিটি গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের মধ্যে গ্রুপিং আছে। যখনই তাঁদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়, তখনই দুই পক্ষ আমার কাছে নালিশ নিয়ে আসে। আমি তখন আলাপ-আলোচনা করে তাঁদের মিলিয়ে দিই, বিরোধ নিষ্পত্তি করে দিই। আমি কমিটি গঠন করে কেন দেব?’

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন জাহির। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। বর্তমানে তিনি হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এর আগে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আবারও নৌকার মাঝি হতে চান আবু জাহির। তিনিসহ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন পাঁচজন।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/district/pz0rbwzn9h