২৩ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৮:০২

গলদঘর্ম

 

দীর্ঘ বিরতির পর সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে চলতি মাসে ট্রাকে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছে। পণ্য কিনতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে মানুষ। টিসিবি ডিলারদের ট্রাকের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে পণ্য কেনার টোকেন না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। আর যারা টোকেন হাতে পান তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। ট্রাক সেলে যা বরাদ্দ থাকে তা দুই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। এরপরও লাইনে থাকা অনেকে ফেরত যান খালি হাতে। 

সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রির পুরনো চিত্র ফিরেছে। গতকাল বেশ কয়েকটি স্থানে টিসিবি’র ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি হয়। পণ্য বিক্রি করার স্থানে ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। চাহিদার তুলনায় পণ্য কম থাকায় দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় বিক্রি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর টিসিবি’র ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে না পেরে অনেকে ফিরেছেন খালি হাতে।

নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে মধ্যবিত্ত অনেকে এখন টিসিবি’র লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। 
ওএমএসের ট্রাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি হয় চাল ও আটা। প্রতি কেজি চাল ৩০ টাকা এবং প্রতি কেজি খোলা আটা ২৪ টাকা। একজন সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি করে চাল ও আটা ক্রয় করতে পারবেন। এদিকে টিসিবি’র ট্রাকে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১০০ টাকা, পিয়াজ ৫০ টাকা কেজি, আলু কেজি ৩০ টাকা, মসুর ডাল ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। 

ওএমএস ট্রাকসেলের বিক্রেতা বাবু বলেন, ১ হাজার কেজি চাল ২০০ জন ক্রেতাকে দিতে পারবো আর আটা ২ হাজার কেজি ৪০০ জনকে। চালের চাহিদা অনেক বেশি। কম থাকায় সবাইকে চাল দিতে পারছি না। প্রায় ৬০-৭০ জনের মতো ক্রেতা চাল না পেয়ে ফিরে গিয়েছে। এই সপ্তাহের প্রতিদিনই বিক্রি করছি এই পণ্য। এক এক জনকে ৫ কেজি আটা ও ৫ কেজি চাল দেয়া হচ্ছে। চালের কেজি ৩০ টাকা ও আটার কেজি ২৪ টাকা। সকাল থেকে ভিড় করে আছে ক্রেতারা। আটার বরাদ্দটা যেটা দিয়েছে সেটা পর্যাপ্ত কিন্তু চালের বরাদ্দ অনেক কম।

কাঁঠালবাগানের ঢাল থেকে চাল ও আটা কিনতে এসেছেন ৭০ বছরের আনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ১২ বছর ধরে ঢাকায় থাকি; কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। সকাল ৯টার দিকে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। এখানে কিছুটা কম দামে কিনতে পারি। বাজারে গেলে কোনো কিছু কিনতে সাহস পাই না। সেই কোরবানির সময় মাংস খেয়েছি আর চোখে দেখিনি। আমার স্বামী অনেক আগে মারা গেছেন। ছেলে নেই; এক মেয়ে ও পাঁচ নাতি-নাতনিকে নিয়ে ঢাকায় থাকি। আগে আমি বাসাবাড়িতে কাজ করে কিছু টাকা আয় করতাম। কিন্তু এখন বয়স ও অসুস্থতার কারণে কিছুই করতে পারি না। মেয়ে বাসাবাড়িতে কাজ করে যে টাকা আয় করে তা দিয়ে আমাদের সাত জনের খরচ চালাতে হয়। এদিকে নাতি-নাতনিরা স্কুলে পড়ে, তাদের খরচ আছে। বাসা ভাড়া ৮ হাজার টাকা প্রতি মাসে দিতে হয়। সংসারের হিসাব মিলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমাদের তো অনেক আগে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন তো শুধু বেঁচে থাকার জন্য দু’মুঠো খাই। চাল আমার বেশি দরকার ছিল কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে শেষ পর্যন্ত চাল পাইনি। পাঁচ কেজি আটা পেয়েছি। 

আরেক ক্রেতা আব্দুল মান্নান বলেন, নাখালপাড়া থেকে সকাল ৮টার সময় এসে দাঁড়িয়েছি। বাজারে সবকিছুর দাম অনেক বেশি। সবকিছু এত বেশি দামে কিনতে হলে না খেয়ে থাকতে হবে। এখানে কম দামে কিনতে পারছি। পাঁচ টাকা থাকলেও প্রয়োজনীয় অরেকটি জিনিস কিনতে পারবো। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকি। একটা সংসারে অনেক কিছুর দরকার হয়। ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়তি কোনো খাবার মুখে দিতে পারি না। তারা কি শুধু ভাত খেয়ে বাঁচতে পারে। ৩০০ টাকা আয় হলে দিনে ৮০০ টাকার মতো খরচ হয়। বাজারে গেলে ৬৫ টাকার নিচে কোনো চাল নেই। এখানে ৩০ টাকা করে নিতে পারছি। বর্তমান যে অবস্থা বাজারে গেলে নিজেকে অসহায় লাগে। চিন্তা করতে হয় কী দিয়ে কী কিনি, কোনটা বেশি দরকার। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মিলাতে পারছি না। 

মারুফা বেগম বলেন, বাজারে গিয়ে কিছু কিনতে গেলে হাত কাঁপে। এখান থেকে কিনলে কিছু টাকা সাশ্রয় হয়। আমি অসুস্থ তাও ট্রাক আসার কথা শুনে সকালে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। একটা ছেলে আছে তার দুর্ঘটনায় হাত-পা ভেঙে গেছে। স্বামী রিকশা চালাতো সে চার বছর আগে মারা যায়। সবকিছুর যে পরিমাণ দাম এক কথায় না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। অসুস্থ শরীরে ভালো-মন্দ কিছু খেতে পারি না। ঘণ্টা দুই দাঁড়িয়ে থেকে ৪৮০ টাকা দিয়ে ২ কেজি আলু, ২ কেজি পিয়াজ, ২ কেজি ডাল, ২ লিটার তেল কিনেছি।

 

https://mzamin.com/news.php?news=84868