২৩ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:৫৮

নেতাকর্মীর স্বজনদের হেনস্তার অভিযোগ

নেতাকে না পেয়ে বাড়িতে ভাঙচুর, কারও বাবা, কারও ভাইকে গ্রেফতার

 

 

বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা রাজনৈতিক দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে একদিকে দেশব্যাপী চলছে সহিংসতা, অপরদিকে চলছে পুলিশের গণগ্রেফতার। সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি চলছে গ্রেফতার অভিযান। অনেক ক্ষেত্রে নেতাদের গ্রেফতার করতে না পেরে তাদের বাড়িতে ভাঙচুর, এমনকি নেতাকর্মীদের স্বজনদের, কারও ভাই, কারও বাবাকেও গ্রেফতারের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের অতি উৎসাহী কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের অনেকের পরিবারই রাজনীতির ‘অভিশাপ’-এ জ্বলছে। তারা আছেন চরম বিপাকে, গ্রেফতার আতঙ্কে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন বেশকিছু ঘটনার তথ্য উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, কালিহাতী উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতিকে না পেয়ে তার ছোট ভাইকে, কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সদস্যকে না পেয়ে তার বাবাকে এবং চনপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদককে না পেয়ে তার বাবাকে গ্রেফতারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া নেত্রকোনা সদর উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ককে বাড়িতে না পেয়ে তার ছোট ভাইকে এবং উপজেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদককে না পেয়ে তার ভাইকে গ্রেফতারের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। এসব ঘটনায় গ্রেফতার স্বজনরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এমন তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

স্বজনদের গ্রেফতারে কারণ জানতে চাইলে পুলিশের অভিযানসংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সন্দেহজনক আসামি হিসাবে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, নেতাকে না পেয়ে যেসব অভিযোগ আসছে, তার সত্যতা মিলছে না।

বিএনপির সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে মহাসমাবেশের ৪ থেকে ৫ দিন আগে থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে মামলা হয়েছে ৩৪৬টির বেশি। এসব মামলায় ১৪ হাজার ৬৭৫ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার অভিযানে গিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী সম্প্রতি একাধিকবার অভিযোগ করেছেন, পুলিশ দিনে-রাতে যে কোনো সময় নেতাকর্মীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। তাদের বাসায় না পেয়ে বাবা, ভাই কিংবা অন্য সদস্যদের অন্যায়ভাবে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনকে থানায় নিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হচ্ছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) অপারেশন্স মো. আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন, এ বিষয়ে পুলিশকে সর্বোচ্চ নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেসব অভিযোগ এসেছে, আমরা প্রতিটি কেস ধরে জিজ্ঞাসা করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১২ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি এসএম নুরুল ইসলামকে গ্রেফতারে তার বাড়ি মগড়া গ্রামে অভিযানে যায় পুলিশ। মগড়া পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা নুরুলকে না পেয়ে তার ছোট ভাই নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। তাকে পুরোনো এক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। নজরুল টাঙ্গাইল মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনিং স্কুলের (এমএটিএস) শিক্ষার্থী।

নুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তার নামে কোনো মামলাও নেই। পড়ালেখার পাশাপাশি সে আমার ওষুধের দোকানে কাজ করে।’

কালিহাতী উপজেলার দশকিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের (মগড়া) ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আব্দুল লতিফ যুগান্তরকে বলেন, নুরুল ইসলাম রাজনীতি করলেও তার ছোট ভাই নজরুল ইসলাম কোনো রাজনীতি করে না। সে ভালো ছেলে।’

ইউপি সদস্য আক্ষেপ করে বলেন, ছেলেটা মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট হিসাবে পড়ালেখা প্রায় শেষ করছে, ইন্টার্ন চলছে, তার জীবনটা শেষ না করতে ইনস্পেকটর স্যারকে অনেক অনুরোধ করেছি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কালিহাতী উপজেলার মগড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক সাইফুল যুগান্তরকে বলেন, ‘সন্দিগ্ধ আসামি হিসাবে তাকে (নজরুল ইসলাম) গ্রেফতার করা হয়।’

কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সদস্য আজিজুর রহমান মুন্নার বাড়ি পাকন্দিয়া থানার তারাকান্দি গ্রামে ১২ নভেম্বর সকালে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় মুন্নাকে না পেয়ে বাড়িতে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ পরিবারের। পরে তারাকান্দি বাজার থেকে মুন্নার বাবা মুদি দোকানি মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আগের এক বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে।

পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, মানিক মিয়া কোনো রাজনৈতিক দলর সঙ্গে যুক্ত না। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই।

আজিজুর রহমান মুন্না যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ আমাকে গ্রেফতারে এসে না পেয়ে বাড়ি ঘেরাও করে রাখে প্রায় ২ ঘণ্টা। এ সময় বাসার মালামাল ভাঙচুর করে এবং আমার মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। বাবাকে গ্রেফতারের পর মিথ্যা, বানোয়াট ককটেল বিস্ফোরক মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে পাকন্দিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাহিদ হাসান সুমন যুগান্তরকে বলেন, ‘তাদের বাড়িতে কোনো অভিযান চালানো হয়নি। সন্দিগ্ধ আসামি হিসাবে দোকান থেকে মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে মামলায় তাকে চালান দেওয়া হয়েছে, সেই মামলার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে।

মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, সে বিএনপি করে। কোনো পদে নেই, সমর্থক হিসাবে আমরা জানি।’

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার চনপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহিন সিকদার। তার স্বজনদের অভিযোগ, ২৭ অক্টোবর পুলিশ চনপাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মাহিনের বাড়িতে অভিযানে যায়। কিন্তু মাহিনকে না পেয়ে বাড়ি থেকে তার বাবা আলী আকবর সিকদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

আলী আকবর সিকদারের স্ত্রী মুক্তা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, ভোর ৪টায় আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন, কোনো দল করেন না। আমার ছেলেকে না পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেছে।

চনপাড়া ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা ও বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, আকবর সিকদার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।

এ বিষয়ে জানতে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদকে একাধিকবার ফোন করলেও ধরেননি। ইনস্পেকটর অপারেশন ও ইনস্পেকটর ইনভেস্টিগেশনও ফোন ধরেননি।

নেত্রকোনা সদর উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সৈয়দ মোকশেদুল আলম রাজিবের বাড়িতে ৮ নভেম্বর অভিযানে যায় পুলিশ। রাজিবকে বাড়িতে না পেয়ে তার ছোট ভাই সৈয়দ আজিজুল হক সজিবকে আটক করে। পরে সজিবকে বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

সৈয়দ মোকশেদুল আলম রাজিব যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, সজিব রাজনীতি করে না। সে নেত্রকোনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। অতীতে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক তুহিন চৌধুরীকে না পেয়ে তার ভাই শফিক রহমান চৌধুরী রাহিনকে গ্রেফতার করে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ। ১০ নভেম্বর রাতে শ্রীমঙ্গলের কালাপুর গ্রামে তুহিনের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। তাকে না পেয়ে কালাপুর বাজার থেকে রাহিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ট্রেনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের এক মামলায় অজ্ঞাত আসামি হিসাবে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তুহিন চৌধুরীর চাচা নূর আলী যুগান্তরকে বলেন, রাহিন রাজনীতি করে না। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি মুদি দোকান আছে তার। এর পাশাপাশি শহরের মানুষকে রক্তের জোগাড় করে দেয় সে। করোনার সময় মানুষের দরজায় দরজায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিনামূল্যে সাপ্লাই দিয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/743174