৭ মে ২০১৭, রবিবার, ১০:৩৭

আত্রাই’র মাতৃনদী করতোয়া ঘোড়ামারায় ভারতের বাঁধ

অভিন্ন নদী আত্রাইয়ের উপর নির্মিত বাংলাদেশের একটি রাবার ড্যাম সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে তিস্তার পানির দাবি থেকে দৃষ্টি ফেরানোর কৌশল বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা আত্রাইয়ের মাতৃনদী করতোয়া এবং এর পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস ঘোড়ামারা নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত ইতোমধ্যেই আত্রাইকে অনেকটাই অকেজো করে ফেলেছে। আর যে রাবার ড্যামের কথা বলা হয়েছে তাতে পশ্চিমবঙ্গের নয়- বেশি ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশেরই।
বাংলাদেশ যখন তিস্তার পানির নায্য হিস্যার জন্য একদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে, অন্যদিকে তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিত্যনতুন ফর্মুলা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ বাংলাদেশের আত্রাই নদী থেকে পানি ছাড়ার দাবি তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। আর এ দাবি নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ফের নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবেন বলেও জানিয়েছেন। এর আগে তিনি তিস্তায় প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য তোর্সা-ধরলার পানি কাজে লাগানোর ফর্মুলা প্রদান করেন। এ দফায় গত ৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার দক্ষিণ দিনাজপুরের নারায়ণপুরে এক জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্রাই নদীর পানি ছাড়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি দাবি জানান। তিনি সেখানে বলেন, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলবেন। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে যখন দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে, সেই মুহূর্তে তিনি এই দাবি তুললেন। গত মাসে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক হয় মমতার। কিন্তু তিনি রাজি না থাকায় তিস্তা পানি চুক্তি হয়নি। এর এক মাস পর মমতা বাংলাদেশের কাছ থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবাহিত আত্রাই নদীর পানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। দিনাজপুর জেলার মোহনপুরের আত্রাই নদীতে একটি রাবার ড্যাম তৈরি করেছে বাংলাদেশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আত্রাই নদে আমাদের না জানিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। বাঁধের ফলে নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কখনো আবার বাঁধ থেকে পানি ছেড়েও দেয়া হচ্ছে। ফলে আচমকা প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা।’ রাজ্যকে না জানিয়ে ওই বাঁধ দেয়া হলো কেন- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রের কাছে জানতে চান তিনি। মমতা বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। ওদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু এ বিষয়টিও দেখতে হবে। এটা দেখার কথা কেন্দ্রের।’
আত্রাই নদীর উৎস ভারতেই
আত্রাইয়ের উৎস ভারতে হলেও এর পানি প্রবাহের বৃহত্তম অংশই বাংলাদেশে অবস্থিত। আত্রাই নদী ব্রহ্মপুত্রের সর্বপশ্চিমের শাখানদী। এর প্রাচীন নাম আত্রেই। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরের ১০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে নদীটির উৎপত্তিস্থল। এর পানির উৎসগুলো হচ্ছে, করতোয়া, ঘোড়ামারা, তালমা, কুরুম, পাঙ্গা, যমুনা ও পাতরাজ নদী। এসব নদীর মধ্যে পাতরাজ ছাড়া বাকিগুলো পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় একত্রিত হয়ে করতোয়া নামে প্রবাহিত হয়। সম্মিলিত এই প্রবাহই পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় ‘আত্রাই’ নাম ধারণ করেছে। আত্রাই বাংলাদেশের দেবীগঞ্জ, বোদা, খানসামা, বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর ও দিনাজপুর সদর হয়ে আবারো পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমরগঞ্জ থানার সমঝিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় ভূ-খ-ে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে ভারতের অংশে মাত্র ২টি থানা কুমরগঞ্জ ও বালুরঘাট থানার ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছে। এরপর আত্রাই বালুরঘাট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার ধামুইরহাট উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এখান থেকে পতœীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা, নওগাঁ সদর, রানীনগর, আত্রাই, সিংড়া, গুরুদাসপুর, চাটমোহর, তাড়াশ, ভাঙ্গুড়া হয়ে প্রথমে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হুরাসাগর নদীতে মিলিত হয়েছে এবং পরে বাঘাবাড়ির কাছে যমুনা নদীতে পতিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৩০০ কি.মি। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ২৭০ কিলোমিটার। আর ভারতের অংশ মাত্র ৩০ কি.মি। নদীর গড় প্রস্থ ১৭৭ মিটার।
অন্যদিকে, আত্রাইয়ের মাতৃনদী করতোয়া ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকণ্ঠপুর অভয়ারণ্য থেকে উৎপত্তি হয়ে রাজগঞ্জ থানা শহরের পাশ দিয়ে বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া উপজেলা হয়ে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় প্রবেশ করেছে। আর এখান থেকেই শুরু আত্রাইয়ের। বৈকণ্ঠপুর অভয়ারণ্য থেকে উৎপত্তি হওয়া অপর নদী ‘ঘোড়ামারা’ বোদা উপজেলা দিয়ে করতোয়ায় মিলেছে। এই সম্মিলিত প্রবাহই দেবীগঞ্জের দক্ষিণে এসে আত্রাই নাম ধারণ করেছে।
করতোয়ার উজানে ব্যারেজ নির্মাণ
আত্রাইয়ের মাতৃনদী করতোয়ার উজানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার আমবাড়িতে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। ফলে বাংলাদেশের দু’টি অংশে ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ আত্রাই পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। ষাটের দশকের প্রথমদিকে এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। এরমধ্যে ওই ব্যারেজটি তিস্তার ওপর স্থাপিত গজলডোবা ব্যারেজের আওতায় আনা হয়েছে। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খালের আওতায় একটি ফিডার ক্যানেল মারফত করতোয়ার ৪২৫ কিউসেক পানি সরিয়ে নেয়া হয়। ফলে ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে শুকিয়ে যায় করতোয়া ও আত্রাইসহ শাখা নদীগুলো। বর্ষা মওসুম ছাড়া বছরের বাকি সময়টা থাকে মরা গাঙ হয়ে। শুকনো মওসুমে এসব নদীতে মাছের পরিবর্তে ধান-পাট চাষ হয়।
ঘোড়ামারা নদীতে স্লুইসগেট
আত্রাইয়ের অপর উৎস ঘোড়ামারা সীমান্ত নদী। ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা থেকে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলা দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে করতোয়ায় মিশেছে। এর অববাহিকা ৬৫ বর্গকিলোমিটার। ভারত এর উপর একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করেছে। এর মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়া ও প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শুকনো মওসুমে নদীটি একেবারে শুকিয়ে যায়। আর আত্রাই বঞ্চিত হয় পানি প্রবাহ থেকে।
আত্রাই নদীর রাবার ড্যাম
কৃষিতে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করার নামে বাংলাদেশের দিনাজপুরের মোহনপুরে আত্রাই নদীতে দেশের সর্ববৃহৎ রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এই রাবার ড্যামটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। আর ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর ড্যামটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাবার ড্যামটি নির্মাণ হওয়ায় সদর উপজেলার শংকরপুর, শেখপুরা, ফাজিলপুর, শশরা ও উথরাইল ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী চিরিরবন্দর উপজেলার সাইতারা, আব্দুলপুর, ভিয়াইল ও আউলিয়া পুকুর ইউনিয়নের কয়েক হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। অন্যদিকে এই রাবার ড্যাম আত্রাইয়ের সুদীর্ঘ পথ- যা বাংলাদেশেরই প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে- এই দীর্ঘ পথের পানিপ্রবাহ ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে চলেছে বলে জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তার এলাকার যে ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন তা খুবই সামান্য। কিন্তু সর্বাধিক ক্ষতির কারণ হয়েছে বাংলাদেশের। একদিকে করতোয়ার বাঁধ ও ঘোড়ামারার স্লইস গেট আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই রাবার ড্যাম।
বিশেষজ্ঞ অভিমত
এবিষয়ে নদী গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, দিনাজপুরে আত্রাইয়ের উপর বাংলাদেশের রাবার ড্যাম সামান্য কিছু এলাকার জন্য উপকারে আসলেও বাস্তবে বৃহত্তর আত্রাইয়ের জন্য তা আত্মঘাতী হয়েছে। এটি নির্মাতাদের ভৌগোলিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও সাময়িক আর্থিক লাভের বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই ছোট্ট একটি প্রকল্প করে তা আন্তর্জাতিক ইস্যু হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য প্রসঙ্গে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, মমতা এই রাবার ড্যামের প্রসঙ্গ তুলে আসলে তিস্তা-মহানন্দার পানির বিষয়টি চাপা দিতে চাচ্ছেন বলেই মনে হয়। এক রাবার ড্যামে যদি তার ২/৪ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে তাহলে তিস্তা-মহানন্দার পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের অন্তত ২ কোটি লোকের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর আত্রাইয়ের মূল ক্ষতি করেছে ভারতীয়রাই- করতোয়ার বাঁধ ও ঘোড়ামারার স্লইস গেট নির্মাণ করে।

http://www.dailysangram.com/post/282811-