২০ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:০০

তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলো

 

এইচ এম আকতার: মূল্যস্ফীতি আর আমানতের সুদ হার মানছে না ব্যাংকগুলো। মেয়াদি আমানতে সুদ তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির কম দেয়া যাবে না। তার পরও মূল্যস্ফীতির অনেক নিচে রয়েছে আমানতের গড় সুদ হার। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির দায় মেটাতে ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলার কেনার চাপে আছে। সে জন্য নগদ টাকায় রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কেনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে পরস্পরের কাছ থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও এখন উচ্চ সুদে টাকা ধার করছে। সব মিলে তারল্য সংকটে ব্যাংকগুলো।

একটা সময়ে ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ ছিল। এখন আর লাভ নেই। চাকরির পাশাপাশি জমানো অর্থ থেকে কিছুটা মুনাফা এলে সংসার চালাতে বেগ পেতে হতো না। যত দিন যাচ্ছে আমানতে মুনাফা কমছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে আমানতও কমতে থাকবে সেদিন বেশি দূরে নয়। সুদ হার তেমন না বাড়লে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন। এতে করে মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে আমিনুল ইসলাম হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন। জানালেন, বেসরকারি একটি ব্যাংকে ২০ লাখ টাকা আমানত রেখেছেন তিনি। এক বছর মেয়াদি আমানতে আগে জমা অর্থের ওপর ৯ শতাংশ সুদ পেতেন, কিন্তু সুদ হার নির্দিষ্ট করে দেয়ায় এখন আর কাক্সিক্ষত হারে মুনাফা মিলছে না। এতে করে সংসার চালাতে তার কষ্ট হচ্ছে।

তিনি জানান,দেশে এখন গড় মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের উপরে। কিন্তু সুদ হার ৫ শতাংশের নিচে। তাহলে কিভাবে সঞ্চয়ীরা সংসার চালাবে। এতে করে ব্যাংকগুলোও তারল্য সংকটে পড়েছে।  আমানতের সুদ হার কিছুটা বাড়ালেও তা কাংখিত নয়। যা খুবই সামান্য। মূল্যস্ফীতির সাথে মিল রেখেই সুদ হার নির্ধারন করতে হবে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আমানত-ঋণের সুদ হার নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে একটা সার্কুলার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ফলে ব্যাংকগুলোতে টাকা, তথা তারল্য নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। সংকট কাটাতে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদেও আমানত নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। তবে সবচেয়ে বেশি তারল্য সংকটে রয়েছে দেশের শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাংকঋণের সুদহার যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে আমানতের সুদ। এরপরও ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত আমানত পাচ্ছে না। ব্যাংকে টাকার টানাটানি সামলাতে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তা বা ধার দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই চিত্র গত সপ্তাহের।

এদিকে তীব্র তারল্য-সংকটের পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা নতুন কোনো প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে না। সুদহার বাড়ানোয় ভোক্তাঋণ বিতরণও কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনাই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য ঋণের সুদহার বাড়িয়ে টাকাকে দামি করা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর। আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কত হলো, আবার সুদহারই-বা কোথায় গেল, সেটা এখন বিবেচ্য নয়।

সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো থেকে টাকা ধার করে। এতে বেড়েছে সুদহার। ১৩ নবেম্বর সরকার ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে ৩ হাজার ৩০ কোটি টাকা তুলেছে, যেখানে সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ। একই দিন ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ৯ দশমিক ৯০ থেকে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সেদিন ৬৪৭ কোটি টাকা তোলে সরকার। ৭৮২ কোটি টাকা তোলা হয় ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে, যার সুদহার ছিল ১০ থেকে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ১৫ নভেম্বর ৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সেদিন সরকার বন্ডের মাধ্যমে ৮১৬ কোটি টাকা তুলেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, ট্রেজারি বিলের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। এতে ঋণের সুদহারও বাড়বে। লক্ষ্য, মূল্যস্ফীতি কমানো।

ট্রেজারি বিলের সুদহারের ভিত্তিতে এখন ব্যাংকঋণের সুদের হার নির্ধারিত হচ্ছে। যে পদ্ধতিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেটাকে বলা হয় স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি নবেম্বর মাসের জন্য স্মার্ট রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলো সাড়ে ৩ শতাংশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার বাড়াতে পারে। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

ঋণের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ও তারল্যে টান পড়ায় আমানতের সুদহার বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। সংকটে পড়া কোনো কোনো ব্যাংক আরও বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। এরপরও চাহিদামতো আমানত পাচ্ছে না বেশির ভাগ ব্যাংক। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ৫ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা।

এদিকে তারল্য-সংকটে পড়ায় শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংককে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকগুলোকে রেপো বা বিশেষ সহায়তা হিসেবে টাকা ধার দিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ১২ নবেম্বর ১৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ১৩ নবেম্বর ১৩ হাজার ৩৭৭ কোটি, ১৪ নবেম্বর ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি ও ১৫ নবেম্বর ১৯ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা দিয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার ক্রয় ও সরকারের ঋণের কারণে নগদ টাকায় টান পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাহিদামতো নগদ জমা রাখার জন্য এখন আগের চেয়ে বেশি তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। আমানতের সুদহার সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তারল্যে চাপ আরও কিছুদিন থাকবে। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ হবে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক অর্থনীতিতে। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে।

https://www.dailysangram.info/post/541149