২০ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৯:৫৭

মার্কিন ডলার সংকট এবং জাতীয় অর্থনীতি

-আশিকুল হামিদ

প্রাত্যহিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য কিছু পণ্য ও বিষয়ের সঙ্গে মার্কিন ডলারের তীব্র সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গভীর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। বাস্তবে বেশ কিছুদিন ধরে দামই শুধু বাড়ছে না, ডলারের সংকটও তীব্রতর হচ্ছে। অর্থনীতির ভাষায় বিনিময় মূল্য হিসেবে চিহ্নিত এই দাম মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল কমবেশি ৮৪ টাকা। সম্প্রতি একই মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে প্রথমে হয়েছে ৯২ থেকে ৯৫ টাকা, কয়েকদিন আগে ডলারের দাম  ১০২-১০৩ টাকাও হয়েছিল। সরকার এবং বাংলাদেশব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেয়ার ফলে ডলারের দাম পর্যায়ক্রমে শুধু বেড়েছেই। ১৭ নভেম্বরের সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, প্রতি মার্কিন ডলার ১২০ থেকে ১২৫ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হচ্ছে।

এ সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রতি ডলারের দাম বা বিনিময় মূল্য যেখানে ছিল ৮৪ দশমিক ৯ টাকা, ২০২২ সালের ১৬ মে সে একই ডলার বেচাকেনা হয়েছে ৮৭ দশমিক ৫ টাকায়। এভাবে শুধু বাড়েইনি, লাফিয়েও বেড়েছে ডলারের মূল্য। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি ডলারের মূল্য ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু নির্ধারিত সে মূল্য অনুযায়ী লেনদেন হতে পারেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ৯২ টাকা দরে বিক্রি করলেও এসময়ে খুচরা বাজারে প্রতি ডলার এমনকি ৯২ থেকে ৯৩ টাকা পর্যন্ত দরে লেনদেন হয়েছে। 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ৪ এপ্রিলও এক মার্কিন ডলারের নির্ধারিত মূল্য ছিল ৮০ টাকা। কিন্তু আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হলেও বৈদেশিক মুদ্রার খুচরা বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কেউ মান্য করেনি। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সোনার ব্যবসায়ীসহ চোরাচালানীরা। সবার মিলিত কর্মকান্ডের পরিণতিতে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ডলারের বাজার অস্থির ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠেছিল। খবরে জানা গেছে, বিদেশিসহ প্রায় সব ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাফেডা’র অর্থাৎ বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন এর নির্দেশনা উপেক্ষা করে যার যেমন খুশি তেমন মূল্যে ডলার কেনা-বেচা করেছে। এর ফলে ডলারের আন্তঃব্যাংক দর যখন ছিল ৮০ টাকা, তখনও কোনো কোনো ব্যাংক এমনকি ৮৮-৮৯ টাকা দরেও ডলার বিক্রি করেছে। ফলে ডলারের দাম উঠে গিয়েছিল ৯২-৯৩ টাকা পর্যন্ত।

এর মধ্যে দেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ‘অবৈধ প্লেয়ার’ হিসেবে দৃশ্যপটে এসে হাজির হয়েছিল। সংবাদপত্রের রিপোর্টে জানা গেছে, এই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার নির্ধারিত কম মূল্যে মার্কিন ডলার কিনে একই ডলার অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছে। এমন অবস্থারই পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছে এই ব্যবসায় জড়িত অন্য সকল প্রতিষ্ঠানও। তারাও যে যেমন পেরেছে তেমন হারে টাকা আদায় করেছে। এর ফলে খোলা বাজারের বেশ কিছু স্থানে প্রতি মার্কিন ডলার এমনকি ১০৫ টাকা পর্যন্ত দরেও বিক্রি হয়েছে। সর্বশেষ খবরে অবশ্য বলা হয়েছে, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক রাশ টেনে ধরায় ডলারের যথেচ্ছ দাম আদায়ের চেষ্টা ও কর্মকান্ডকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৮০-৮৫ টাকার ডলার ১০০ টাকার ওপরেই বিক্রি হয়েছে। 

বলা দরকার, মার্কিন ডলার যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান বিনিময় মাধ্যম সেহেতু ডলারের দাম এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও অনেক কমে গেছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ  ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে কমে এসেছে। অথচ ২০২১ সালের আগস্ট মাসেও রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রিজার্ভের এমন অবস্থা হওয়ার কারণ, চাহিদা মেটানোর জন্য সম্প্রতি মাত্র দু’-তিন মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। একই কারণে ডলারের দামও বেড়ে চলেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে একদিকে ঘাটতি এবং অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়তে থাকলে আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না এবং প্রচন্ড চাপের মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। বাড়বে চাল-ডালসহ প্রতিটি পণ্যের দামÑ বাস্তবে এসব পণ্যের দাম এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। পরিণামে স্বল্পসময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক সংকটে পড়বে। নাভিশ্বাস উঠবে সাধারণ মানুষের।

বাণিজ্য ঘাটতি সংক্রান্ত খবর ও তথ্য-পরিসংখ্যানগুলো যে অত্যন্ত আশংকাজনক সেকথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানা গেছে, বিপুল এই ঘাটতির পেছনে যথারীতি প্রধান ভূমিকা রয়েছে ভারতের। প্রতিবেশি দেশটি থেকে আমদানি লাফিয়ে বাড়লেও নানা ধরনের শুল্ক-অশুল্ক ও আধাশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের রফতানি বাড়তে পারছে না। ফলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট গুণেরও বেশি। এরই পাশাপাশি একদিকে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে আমদানির আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হচ্ছে। 

এমন অবস্থায় সরকারের উচিত নজরদারি বাড়ানো এবং বিশেষ করে মার্কিন ডলারের ব্যাপারে সরাসরি ভ’মিকা রাখা। প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করা। সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে, খাদ্য ও যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার করা হচ্ছে কি না।  একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ও প্রবাহ বাড়ানো দরকার, যাতে শিল্পায়নের পাশাপাশি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানি বাড়ানো যায়। আমদানির সময়ও লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামালের বাইরে এমন কিছু আমদানির সুযোগ সৃষ্টি না হতে পারে, যার আড়াল নিয়ে বা অজুহাত দেখিয়ে চিহ্নিত কিছু বিশেষ গোষ্ঠী বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করতে পারবে। অর্থাৎ দেশকে বাণিজ্য ঘাটতির কবল থেকে মুক্ত করতে হলে অর্থের পাচার অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। 

বলা দরকার, সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ না নেয়ার ফলে এরই মধ্যে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়তে শুরু করেছে। দু’দিন আগে, গত ১৮ নভেম্বরও একই সঙ্গে গম, আটা এবং চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। এমন অবস্থার মধ্যে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যেখানে সরকারের দায়িত্ব সেখানে মূল্য নির্ধারণের নামে সরকার নিজেই মূল্য বাড়িয়ে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের কথা উল্লেখ করা যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় এভাবে এবং এত বেশি পরিমাণ বৃদ্ধির কথা কল্পনা করা যায় না। অন্যদিকে বাংলাদেশে সেটাই ঘটে চলেছে এবং মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরার  কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। 

ওদিকে আলু, পেঁয়াজ আর ডিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অন্য সব পণ্যের মূল্যও। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে এসেছে মার্কিন ডলারের প্রসঙ্গ। কারণ, ডলারের মাধ্যমেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন করা হয়। ডলারের ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কিছুদিন আগে সরকার ভারতের রুপিকে বিনিময় মুদ্রায় পরিণত করে দেখেছে। ধারণা করা হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে মার্কিন ডলারের সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে ডলারের সংকট উল্টো আরও গভীর হয়েছে। 

আমরা উদ্বিগ্ন এজন্য যে, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি বছর ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসেও প্রতি মার্কিন ডলারের নির্ধারিত মূল্য ছিল ৮০ টাকা। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার খুচরা বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কেউ মেনে চলেনি। তাদের সঙ্গে সোনার ব্যবসায়ীসহ চোরাচালানীরা যোগ দেয়ায় পরিণতিতে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ডলারের বাজার অস্থির ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। এসময় বিদেশিসহ প্রায় সব ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে। তারা যার যেমন খুশি তেমন মূল্যে ডলার কেনা-বেচা করেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার নির্ধারিত কম মূল্যে মার্কিন ডলার কিনে একই ডলার অনেক বেশি দামে বাইরে বিক্রি করেছে। এমন অবস্থারই পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল এই ব্যবসায় জড়িত অন্য সকল প্রতিষ্ঠানও। তারাও যে যেমন পেরেছে তেমন হারে টাকা আদায় করেছে। এর ফলে খোলা বাজারে প্রতি মার্কিন ডলার এমনকি ১১০ টাকা পর্যন্ত দরেও বিক্রি হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মার্কিন ডলার যেহেতু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান বিনিময় মাধ্যম সেহেতু ডলারের দাম এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমে যেতে পারে। বাস্তবে অনেক কমে গেছেও। একই কারণে ডলারের দামও বেড়ে চলেছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এভাবে একদিকে বাণিজ্য ঘাটতি এবং অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়তে থাকলে আমদানি-রফতানির ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে না এবং প্রচন্ড চাপের মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন টাকার অবমূল্যায়ন করতে হবে। বাস্তবে অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছেও। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতিই শুধু অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে না, বাড়ছে চাল-ডালসহ প্রতিটি পণ্যের দামও।  পরিণামে স্বল্পসময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতিও মারাত্মক সংকটে পড়েছে এবং নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের উচিত নজরদারি বাড়ানো এবং বিশেষ করে ডলারের ব্যাপারে সরাসরি ভূমিকা রাখা। প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করা। সংকটের আড়ালে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হচ্ছে কি না সে ব্যাপারেও সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমদানির সময়ও এমন কোনো পণ্য আমদানির সুযোগ দেয়া যাবে না, যার অজুহাত দেখিয়ে চিহ্নিত গোষ্ঠীগুলো অর্থ পাচার করতে পারবে। আমরা আশা করতে চাই, মার্কিন ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতির সকল বিষয়ে সরকার জনগণের স্বার্থে কঠোর ভূমিকা পালন করবে। 

 

https://www.dailysangram.info/post/541118