৭ মে ২০১৭, রবিবার, ১০:৩৪

বারবার ছন্দপতনে হতাশ সবাই

নতুন পদ্ধতির খেসারত দিলো শিক্ষার্থীরা

বারবার ছন্দপতন ঘটছে শিক্ষাক্ষেত্রে। কখনো প্রশ্নফাঁসের নৈরাজ্য, কখনো পাঠ্যবই পরিবর্তন, কখনো সিলেবাস পরিবর্তন, কখনো নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি, নতুন ফলাফল পদ্ধতি, নতুন খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি, নতুন শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থী আর অভিভাবকেরা। ২০০৯ সালের পর থেকে সাত বছর ধরে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক দিকে হয়েছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অপর দিকে প্রশ্নফাঁসসহ নানা ধরনের নৈরাজ্য চলেছে। প্রতিবার প্রতিটি ক্ষেত্রে এসবের খেসারত দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে শিক্ষার মান। গণহারে জিপিএ ৫ প্রাপ্তির কারণে ইমেজ সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে প্রকৃত মেধাবীরা।
হাত খুলে নম্বর দিয়ে পাবলিক পরীক্ষায় গণহারে জিপিএ ৫সহ নানাবিধ নৈরাজ্য সৃষ্টির পর এখন হাত গুটানোর পর্ব শুরু হয়েছে। আর তারও খেসারত দিতে হলো বিপুল কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরই। এবার এসএসসিতে নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নের সর্বাধিক মূল্য দিতে হয়েছে কুমিল্লা বোর্ড ও মাদরাসার শিক্ষার্থীদের। কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার গত বছরের চেয়ে কমেছে শতকরা ২৫ ভাগ। আর মাদরাসায় এবার জিপিএ ৫ নেমে এসেছে গত বছরের অর্ধেকেরও কমে। গত বছর কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ছিল শতকরা ৮৪ ভাগ। এবার তা নেমে এসেছে ৫৯-এ। গত বছর মাদরাসায় জিপিএ ৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৮৯৫ জন। এবার পেল মাত্র দুই হাজার ৬১০ জন। কমেছে তিন হাজার ২৮৫ জন। আর দশ বোর্ড মিলিয়ে পাসের হার কমেছে প্রায় ৮ ভাগ। ফলাফলের এ পরিবর্তনের মূলে ধরা হচ্ছে নতুন খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতিকে।
সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করা নিয়ে কারো কোনো ভিন্নমত নেই; বরং সবারই দাবি সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়নের জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রকৃত মেধা যাচাই করা হোক। এবার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে খাতা মূল্যায়নের প্রভাবের কারণে স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসেছে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্যের বিষয়টি। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় গণহারে জিপিএ ৫ আর উচ্চ পাসের হারের কারণ অনুসন্ধানে ভয়ঙ্কর চিত্র বেরিয়ে এসেছে বেশ আগেই। অনেক পরীক্ষক জানিয়েছেন খাতায় শিক্ষার্থী যাই লিখুক না কেন বোর্ডের পক্ষ থেকে হাত খুলে নম্বর দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে অতীতে। হাত খুলে নম্বর দেয়ার বিষয়ে বোর্ডের কর্মকর্তারা যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন অনেক শিক্ষক। অনেকে বিবেকের তাড়নায় খাতা দেখা ছেড়ে দিয়েছেন। শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, নম্বর কম দেয়ার কারণে বিভিন্ন পরীক্ষককে বোর্ডে ডেকে অকথ্য ভাষা গালিগালাজ করা হয়েছে। হাত খুলে নম্বর দেয়ার পাশাপাশি পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের সহায়তারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষার হলে শিক্ষকের প্রশ্ন বলে দেয়া, শিক্ষার্থীদের জড়ো হয়ে প্রশ্ন সমাধানের ভিডিও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে। তদুপরি ছিল মহামারী আকারে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। অপর দিকে বোর্ডের নির্দেশনার পর গত কয়েক বছর পর শিক্ষক আর বোর্ডের মধ্যে শুরু হয় কে কত বেশি নম্বর দিতে পারে তার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ফলে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ নিয়ে শিক্ষার্থীদের চমকপ্রদ আর ন্যক্কারজনক বিভিন্ন খবর প্রকাশিত হতে থাকে। শিক্ষাক্ষেত্রে নেমে আসে ভয়াবহ নৈরাজ্য। গণহারে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহারে ফেলের পর থমকে দাঁড়ায় গোটা জাতি।
গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃষ্ট প্রতিটি নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার চরম মূল্য দিয়েছেন সারা দেশের কোটি শিক্ষার্থী আর অভিভাবকেরা। প্রচণ্ড হতাশা আর ক্ষোভ বিরাজ করছে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে। অনেকে ভেঙে পড়ছেন হতাশায়। অনেক মা-বাবা জানিয়েছেন, তাদের সন্তানেরা মাঝে মধ্যে চিৎকার করে বলছে পড়াশোনাই আর করব না।
চট্টগ্রাম শিা বোর্ড সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের এসএসসি পরীায় বহুনির্বাচনী প্রশ্নের (এমসিকিউ) অংশে ১০ নম্বর কমেছে। এ ১০ নম্বর যুক্ত হয়েছে সৃজনশীল অংশে। ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর শিা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শেষে শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামে মানববন্ধন ও মিছিল-সমাবেশ করেছিল শিার্থীরা।
চট্টগ্রাম নগরের ডা: খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক হাসমত জাহান জানিয়েছেন, নতুন পদ্ধতির সিদ্ধান্তটি পরীার্থীরা জানতে পারে দশম শ্রেণীতে ওঠার পর। নবম শ্রেণীর শুরুতে জানতে পারলে শিার্থীরা আরো বেশি অনুশীলন করতে পারত।
সর্বশেষ গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে সৃজনশীল নিয়ে রাস্তায় নামে সারা দেশের এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিÑ ছয়টির স্থলে সাতটি সৃজনশীল তারা মানবে না। এটি পরিবর্তন করতে হবে। হঠাৎ করে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তে তারা বিভ্রান্ত। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তঃশিক্ষা বোর্ড থেকে জারি করা নিয়মে বলা হয় ২০১৭ সাল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে সাতটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয় শিক্ষার্থীদের।
এর প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে ‘মানি না মানব না, সাতটি সৃজনশীল লিখব না, আমরা মানুষ রোবট নই, সাতটি সৃজনশীল লিখব না, সাতটি সৃজনশীল বাতিল কর প্রভৃতি স্লোগানসংবলিত ব্যানার লিখে রাস্তায় অবস্থান করে। এ সময় তাদের সাথে অনেক অভিভাবকও যোগ দেন।
এইচএসসির শিক্ষার্থীরা তখন জানিয়েছিল, আগামী ২২ অক্টোবর তাদের টেস্ট পরীক্ষা। ২০১৭ সালের এপ্রিলে ফাইনাল পরীক্ষা। এমন সময় হঠাৎ করে আমাদের ওপর নতুন নিয়ম চাপিয়ে দেয়া হলো। আমাদের কোনো ধরনের প্রস্তুতি নেই। আমরা আগে সাতটি সৃজনশীল লিখিনি। তা ছাড়া সৃজনশীল লেখার জন্য খুবই কম সময় বরাদ্দ করা হয়েছে। আগে ছয়টি প্রশ্নের জন্য সময় ছিল ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট। এখন একটি প্রশ্ন বাড়িয়ে সময় বাড়িয়েছে মাত্র ১০ মিনিট। এখন সাতটি সৃজনশীলের জন্য মোট সময় দেয়া হয়েছে আড়াই ঘণ্টা। যেখানে আগেই ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটে ছয়টি প্রশ্ন লিখে শেষ করা যেত না, এখন সেখানে একটি প্রশ্ন বাড়িয়ে মাত্র ১০ মিনিট সময় বাড়ানো হয়েছে। এত কম সময়ে আমরা কিভাবে সাতটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখব? এটি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা এটি বাতিল চাই। আমাদের ওপর এভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। আমরা ছয়টির বেশি সৃজনশীল লিখব না।
এক সময় সারা দেশের শিক্ষার্থীরা গণিতে সৃজনশীল চালুর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। ২০১০ সালে এসএসসিতে প্রথম বারের মতো দুইটি বিষয়ে সৃজনশীল পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিষয় বাড়ানো হয়। এইচএসসিতেও বর্তমানে প্রায় সব বিষয় সৃজনশীলের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তা ছাড়া প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকেরও প্রায় সব বিষয়ে পর্যায়ক্রমে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে। একের পর এক বিভিন্ন বিষয় সৃজনশীলের আওতায় নিয়ে আসায় প্রায়ই প্রতিবাদে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। যদিও সৃজনশীল পদ্ধতি রপ্ত করার বিষয়ে সরকারি প্রতিবেদনই অত্যন্ত নাজুক চিত্র বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়।
গ্রামপর্যায়ের বেশির ভাগ শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি ভালো করে রপ্ত করতে পারেননি। এখনো সৃজনশীল নিয়ে ভীতি কাজ করছে অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে।
২০১০ সালে চূড়ান্ত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের আগেই ২০০৯ সাল থেকে সারা দেশে জাতীয়ভাবে একযোগে পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয়। একই কায়দায় অষ্টম শ্রেণী জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হয় এবং এ দুইটি পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষায় রূপ নেয়। এ পরীক্ষা ঘিরে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে শুরু হয় এক ধরনের অস্থিরতা। পরীক্ষা ঘিরে শুরু হয় কোচিং প্রাইভেটের নতুন দৌরাত্ম্য। এরপর শুরু হয় প্রশ্নফাঁসের উৎসব। প্রশ্নফাঁস ভেঙে দেয় জাতির মেরুদণ্ড। প্রশ্নফাঁস নিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র ক্ষোভ এবং হতাশা। এ ছাড়া সমাপনী থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত গণহারে পাস এবং জিপিএ ৫-এর বিস্ফোরণে নতুন বিতর্ক শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে শিক্ষার মান নিয়ে।
সনাতন শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বপ্রথম বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয় ১৯৯২ সালে ৫০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে। এখনো শিক্ষার মান ধসের অন্যতম সূচনাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ পদ্ধতিকে। এরপর জিপিএ ৫, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিতর্কিত বিষয় হিসেবে অন্তুর্ভুক্ত হয় আজো যার খেসারত দিয়ে চলছে শিক্ষার্থীরা। সাম্প্রতিক শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উঠেছে তারও পেছনে রয়েছে সৃজনশীল ব্যবস্থা। এর সাথে যোগ হয়েছে প্রশ্নফাঁসহসহ নানাবিধ নৈরাজ্য। সৃজনশীল নিয়ে এখনো রাস্তায় নামছে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। তার ওপর আছে পাঠ্যবই পরিবর্তনের ধকল।
অপর দিকে সমাপনী এবং জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভীতি আর অস্থিরতা কাটছেনা কোনো অবস্থাতেই। ঘনঘন পাবলিক পরীক্ষা আর কোচিং প্রাইভৈট নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ অভিভাবক। সমাপনী ও জেডিসি/জেএসসসি পরীক্ষা শুরুর পর এ নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ভীতি আর অস্থিরতার মধ্যে শুরু হয় একের পর এক প্রশ্নফাঁসের উৎসব। মেধাবী শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ এবং হতাশা।
তিন কারণে এবার এসএসসি ও সমমান পরীায় ফলাফল আগের বারের চেয়ে খারাপ হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, প্রশ্নফাঁস রোধ এবং পরীাকেন্দ্রে কড়াকড়ি আরোপ। ৪ মে সচিবালয়ে পরীার ফল নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ কথা জানান।
শিামন্ত্রী বলেন, ‘ছোটখাটো অনেক কারণ আছে পরীার ফল বিপর্যয়ের। তবে এর মূল কারণ নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন। প্রশ্নফাঁস রোধ ও পরীাকেন্দ্রে কড়াকড়ির কারণেও আগের বছরের চেয়ে কম পাস করেছে। তবে ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে বিপর্যয় নয়, এ বছর সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।’
শিামন্ত্রী বলেন, ‘বোর্ডগুলো বেশকিছু কঠোর পদপে নিয়েছে। প্রধান পরীকদের উত্তরমালা প্রণয়নের জন্য বিশেষ প্রশিণ দেয়া হয়েছে। সাধারণ পরীকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য একটি প্রশ্নমালা সব প্রধান পরীককে সরবরাহ করা হয়েছে। এ কারণে এবার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।
খাতা মূল্যায়ন নিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘পরীা মূল্যায়নে কোনো পদ্ধতি ছিল না। শত শত বছর এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু আমরা এখন একটা মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেছি। এবার আমাদের ফলাফল দেখে মনে হবে অনেক বেশি ফেল করেছে। মনে হতে পারে, আমাদের ছেলেমেয়েরা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে দেখলে হবে না। এমন ফলাফলের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। আমরা জানতাম এবার যেভাবে আমরা পরীার ফলাফল মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করেছি সেটার কারণে এমনটা হয়েছে। আমাদের খাতা দেখার পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল।
মন্ত্রী বলেন, ‘এবার আমরা শিকদের খাতা দেখার বিষয়ে প্রশিণ দিয়েছি। কিভাবে খাতা দেখবে। নম্বর দেয়ার েেত্র একটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম ফলো করার বিষয়ে অনুসরণ করা হয়েছে। এসব কারণে এবার খাতা দেখার েেত্র সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।
হাত খুলে নম্বর দেয়ার সেই ভয়াবহ তথ্য : শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবার এসএসসিতে পাসের হার কমার বিষয়ে খাতা মূল্যায়নের যে তথ্য দিলেন তাতে প্রমাণ করে অতীতে খাতা মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয়নি। এবার সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন করায় পাসের হার কমেছে। খাতা মূল্যায়ন নিয়ে অতীতে যেসব ভয়াবহ নৈরাজ্যের অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে তাও সত্য প্রমাণিত হলো। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় গণহারে পাস এবং জিপিএ ৫ পাওয়ার পেছনে যেসব কারণ তুলে ধরা হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল খাতা মূল্যায়ন নিয়ে নৈরাজ্য।
খাতা মূল্যায়নে নৈরাজ্য নিয়ে ২০১৪ সালে দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রতিবেদনে যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল তার মধ্যে কয়েকটি ছিল এ রকমÑ
একজন প্রধান পরীক্ষক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার খাতায় ১৯ জন শিক্ষার্থীকে ৭৪ করে নম্বর দিয়েছেন। এরপরে তাকে তার উপরস্থ কর্মকর্তা তলব করেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি ১৯ জন ছাত্রছাত্রীকে ৮০ করে দিলেন না। পরীক্ষক বিনয়ের সাথে জানান, ৭৪ দেয়া হয়েছে খুব কষ্ট করে। আসলে তারা ৭৪ পাওয়ারই উপযুক্ত ছিল না। তাই আর নম্বর বাড়ানো গেল না। কিন্তু তারপরও তাকে ৮০ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করায় এরপর থেকে ওই পরীক্ষক খাতা দেখা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন।
আরেকজন প্রধান পরীক্ষক জানান, বছর তিনেক আগে উচ্চ মাধ্যমিকে খাতা বিতরণের আগে তাদের ডেকে বৈঠক করা হয় বোর্ড অফিসে। বৈঠকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের কর্মকর্তারা তাদের সবাইকে একটি করে খাতা দিয়ে তাতে নম্বর দিতে বলেন। পরীক্ষকেরা খাতা মূল্যায়ন করে যার যার মতো করে নম্বর দিয়েছেন। যারা খাতায় কম নম্বর দিয়েছেন তাদের তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে একজন কর্মকর্তারা বলেন, নম্বর কী আপনার বাপের? নম্বর দিতে এত কষ্ট হয় কেন? হাত খুলে নম্বর দিতে হবে। নম্বর বেশি দিতে না পারলে খাতা দেখবেন না।
এ সময় একজন পরীক্ষক বলেন, স্যার শিক্ষার্থীরা না লিখলে আমরা কিভাবে নম্বর দেবো খাতায়। আমগাছ লিখতে বলায় যদি বট গাছ লেখে তাহলে নম্বর দিই কী করে। তখন কর্মকর্তারা তাদের ধমকিয়ে বলেন, গাছইতো লিখেছে। দেখতে হবে গাছ সম্পর্কে তার ধারণা আছে কিনা। গাছ বিষয়টা সে বোঝাতে পেরেছে কি না। আমগাছ না বটগাছ সেটা কোনো বিষয় না। গাছ হলেই হলো।
কয়েকজন প্রধান পরীক্ষক জানান, খাতা বিতরণের আগে বৈঠকে একটি বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, বোর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। আমাদের ভালো করতে হবে। বেশি করে নম্বর দিতে হবে।
২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৪ সাল ছিল পাবলিক পরীক্ষাীয় প্রশ্নফাঁসের হিড়িকের বছর। ২০১৪ সালে বছর জুড়ে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সাল সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় এইসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা। ২০১৪ সালের চারটি পাবলিক পরীক্ষার তিনটিতে প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মেলে। এ তিনটি হলোÑ সমাপনী, এসএসসি ও এইচএসসি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে পরিমাণ প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি অতীতে।
গত কয়েক বছর ধরে প্রশ্নফাঁসের মহামারীর কারণে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হন মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা।
শিক্ষা নিয়ে যাই করা হচ্ছে তার মূল্য দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা নিয়ে তাই শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের দুর্ভাবনার যেন শেষ নেই।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/217962