৭ মে ২০১৭, রবিবার, ১০:৩২

দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাচার

জড়িত এক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও আমলা * দেশে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে বিপুল অংকের টাকা

লাগামহীন দুর্নীতির টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত এক শ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী। দেশে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। অপ্রদর্শিত অর্থ চলে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। তবে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের নামে অর্থ পাচারের তথ্য সঠিক নয়। থাকলেও যৎসামান্য। কারণ আমদানি-রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের টাকা পাচারের প্রয়োজন নেই। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দেশের মধ্যে বিনিয়োগ ও পুঁজি বাড়ানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। আর ব্যবসায়ীর সাইনবোর্ড লাগিয়ে যারা এ প্রক্রিয়ার টাকা পাচার করেন তারা বড় ধড়িবাজ। সমাজে ব্যাংক ও আর্থিক সেক্টর লুটপাটকারী হিসেবে পরিচিত।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) সম্প্রতি টাকা পাচারের উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশের পর বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয়- টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে দুর্নীতিবাজরা একই ফর্মুলা অনুসরণ করে। বিশ্লেষকদের একজনের মতে, কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘বড় প্রকল্প মানে বড় দাঁও মারা।’ অর্থাৎ বড় বড় প্রকল্প থেকে আগাম কমিশন হিসেবে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও আমলারা সিন্ডিকেট করে এসব হাইপ্রোফাইল দুর্নীতি করছেন বলে বাজারে যথেষ্ট বিশ্বাস করার মতো পারসেপশন আছে। এমনকি যারা এসব টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচারে সহযোগিতা করছেন তারাও বড় বড় মাফিয়া, যারা নানা পন্থায় ঘুষ-দুর্নীতির টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসতে পারলে টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদ ও আমলারা সবাই দেশ থেকে পালিয়ে যাবেন। আসলে এরা সুবিধাবাদী। তাই আগেভাগে বিদেশে অ্যাপার্টমেন্ট ও বিলাসবহুল বাড়ি কেনা ছাড়াও নানাভাবে বিনিয়োগ করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর বাইরেও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা ও লন্ডনসহ কয়েকটি দেশে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। সেটিও বেশিরভাগ দুর্নীতির টাকা। তবে দেশের মধ্যে প্লট, ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে টাকার উৎস জানা বাধ্যতামূলক করা না হলে কিংবা কিছু সময়ের জন্য অপ্রদর্শিত টাকা কোনো প্রশ্ন উত্থাপন ছাড়াই বিনিয়োগ করার সুযোগ দিলে এসব টাকা পাচার হতো না। আবাসন খাতসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সেক্টর চাঙ্গা হয়ে উঠত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দেশে কালো টাকার সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। রাজনীতিবিদ, কিছু ব্যবসায়ী এবং আমলারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচার করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় দুর্নীতিবাজরা দেশে টাকা রাখছেন না। দেশে দুর্যোগের সময় তারা যাতে আরো ভালো থাকতে পারেন সেজন্য দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে রাখছেন। তিনি বলেন, এ অবৈধ কালো টাকার মাধ্যমে কানাডার বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, টাকা পাচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীরব ভূমিকা গ্রহণযোগ্য নয়। তারা সব সময় নিজেদের গা বাঁচিয়ে কথা বলে। কারণ টাকা পাচার না হলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে চার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হল কিভাবে। তার মতে, কানাডায় বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করেন এমন একটি এলাকার নাম হয়েছে বেগমপাড়া। বিশেষ দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা ওখানে টাকা পাচার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। হংকংয়ে অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর অফিস রয়েছে। সেখানে তারা পুঁজি পাচার করে নিয়মিত ব্যবসা করছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেন, প্রথমত একেবারে উপর থেকে হাইপ্রোফাইল দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটি যতক্ষণ করা যাবে না ততক্ষণ রাঘববোয়ালদের দুর্নীতি বন্ধ হবে না। অগত্যা টাকা তো পাচার হবেই। বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ১০ বছরে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকা বেশি পাচার হয়েছে, যা দেশের জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণ। তারা মনে করেন, এসব টাকা কোনোভাবেই আর ফেরত আনা সম্ভব নয়। তাই দেশের টাকা যাতে বিদেশে চলে না যায় তার একমাত্র উপায় হল বিনিয়োগের রাস্তা সুপ্রশস্ত করা। এজন্য সরকারকে সময়োপযোগী কার্যকর পলিসি গ্রহণ করতে হবে।

জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, তিন কারণে বিদেশে টাকা পাচার হতে পারে। প্রথমত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কিছু লোক বিদেশে টাকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা পাচার হতে পারে। এছাড়াও বিনিয়োগে মন্দা কারণে ব্যবসায়ীদের টাকা বিদেশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, কারণ যাই হোক, টাকা পাচার হওয়া দেশের জন্য সুখবর নয়। তার মতে, সরকারের দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। টাকা ফিরিয়ে আনা এবং জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে একযোগে কাজ করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমদে যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হয়েছে। এর মূল কারণ হল, বিভিন্ন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে কর অত্যন্ত বেশি। উন্নত দেশগুলোতে ২০ শতাংশের বেশি কর্পোরেট কর নেই। কিন্তু বাংলাদেশে তা ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। এ ধরনের উচ্চ কর অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার মতে, আইন করে টাকা পাচার বন্ধ করা যাবে না। পৃথিবীর কোনো দেশ তা পারেনি। আবু আহমেদ আরও বলেন, করদাতাদের সুযোগ দিতে হবে। জানাতে হবে- যদি তারা দেশে অর্থ বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করেন তবে কর অব্যাহতি দেয়া হবে। এতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। টাকা পাচারের হারও কমবে।

জিএফআইর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে দেশ থেকে ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত বছর প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের রিপোর্টে বলা হয়, দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বাড়ছে। টাকা পাচারের তথ্য এসেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির রিপোর্টে। সূত্র বলছে, দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। ওইসব টাকায় দুর্নীতিবাজরা বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলছেন, জমা রাখছেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। এর বাইরে আরও অনেক ব্যাংকে বাংলাদেশের টাকা পাচারকারীদের টাকা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। প্রশ্ন হল, তারপরেও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় কিভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। কানাডায় রয়েছে বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চল বেগমপাড়া। এছাড়া ব্রিটেন, হংকং, সিংঙ্গাপুরের বিভিন্ন ব্যাংকেও বাংলাদেশিদের টাকা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এ সংক্রান্ত এক তদন্ত প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়।

জানা গেছে, আইনের প্রয়োগ না থাকায় বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে হুন্ডি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি টাকা পাচারের আরও একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিটেন্স। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিটেন্স একটি চক্র সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়। আর এ দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা গ্রহণ করে তার পরিশোধ দেখায়। এখানে তারা কমিশন বাণিজ্য করে। যাকে সহজে হুন্ডি বলা হয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। যা এ প্রক্রিয়ায় বিদেশের কোনো ব্যাংকে রাখা হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেন, জিএফআই বিশ্বের সব দেশের রিপোর্ট করে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেরও নাম এসেছে। তিনি বলেন, জিএফআইর তথ্যের সূত্রের ব্যাপারে জানা নেই। সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য পাওয়া গেলে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সজাগ রয়েছে।

জানা গেছে, বাইরের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কালো টাকার সঞ্চালন স্তিমিত হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এখন আর কালো টাকা রাখা যায় না। আগে ব্যাংকগুলোতে কালো টাকা রাখা যেত। বর্তমানে নিজের অ্যাকাউন্টে বেশি টাকা জমা দিতে গেলে আয়ের উৎস জানাতে হয়। এছাড়া এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে কেউ টাকা জমা দিতে গেলেও জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে। আগে বিয়ারার সার্টিফিকেট অব ডিপোজিটের (বিসিডি) নামের একটি সঞ্চয়ী প্রকল্পের আওতায় এসব টাকা জমা রাখার সুযোগ ছিল। এভাবে টাকা রাখলে কোনো নাম-ঠিকানা দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। গ্রাহকদের শুধু একটি নম্বর দেয়া হতো। গ্রাহক মেয়াদ শেষে ওই নম্বর দেখিয়ে মুনাফাসহ টাকা নিয়ে যেতেন। এখন আর সে সুযোগ নেই।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/05/07/122750/