১৫ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৪:৩৫

টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নে ক্ষতির মুখে ব্যবসায়ীরা

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খোলাবাজারে ডলারের দাম। গতকাল রেকর্ড ১২৬ টাকায় ডলার বিক্রি হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ব্যাংক বড় অংকের নগদ ডলার কেনায় এমন সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের প্রভাবেও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এবার ডলার সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। ঋণ না পাওয়ায় দেশের অনেক উদ্যোক্তাই এখন কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

আমানুল হক একটি বেসরকারি মেডিকেলে চাকরি করেন। বাবা-মায়ের চিকিৎসার জন্য ভারতে যাবেন। কিন্তু ডলার কিনতে পারছেন না। বাড়তি দাম দিয়েও মিলছে না ডলার। তাই টেনশনে আছেন। সময়মতো ডলার না পেলে বিপদের আশঙ্কা করছেন তিনি।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মানি এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, ডলারের মূল্য বেঁধে দেয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে বাজারে। অনেকে ডলার স্টক করছেন। ইতোমধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ী ও আমলাদের ঘরে ডলার মজুতের অভিযোগ তুলেছেন তারা। বিক্রেতারা বলছেন, আমাদের এখানে ডলারের প্রচুর চাহিদা আছে। কিন্তু জোগান পাচ্ছি না। দেশে বিদ্যমান রেটে ডলার কেনা যাচ্ছে না। ফলে বিক্রিও করতে পারছি না।

অপরদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, খোলাবাজার থেকে ব্যাংক নগদ ডলার সংগ্রহ করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কার্ব মার্কেটে। তাই সাধারণ ক্রেতারা খোঁজ পাচ্ছেন না সোনার হরিণ বনে যাওয়া নগদ ডলারের। পেলেও দাম অনেক বেশী। শরিফ নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ব্যাংকের যখন ডলার দরকার হচ্ছে, তখন খোলাবাজার থেকে সমানে তা কিনে নিচ্ছে তারা। ফলে আমরা পাচ্ছি না। মানি এক্সচেঞ্জে ডলার কিনতে এসেছি।

প্রথমে বললো ১২৬ টাকা। এখন বলছে ১২৭ টাকা। সেই দাম দিয়েও চাহিদামত পাওয়া যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক বিক্রেতা বলেন, সাধারণত প্রবাসীরা ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠান। সেখানে যে দামে কেনা হয়, তার সঙ্গে আমাদের সমন্বয় করলে আমরা লেনদেন করতে পারবো। 

জানা গেছে, ডলার সংকটে দেশের আমদানি সংকুচিত হচ্ছে দুই বছর ধরে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে না পারায় স্থবির হতে বসেছে অনেক শিল্প। টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়নের প্রভাবেও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এবার ডলার সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। ঋণ না পাওয়ায় দেশের অনেক উদ্যোক্তাই এখন কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় সমৃদ্ধি নয়, বরং সংকোচনের মুখে পড়েছে দেশের বেসরকারি খাত। যদিও দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও কর্মসংস্থানের বড় অংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। এ খাত প্রাণবন্ত থাকলে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধির পথে চলে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হয় কাক্সিক্ষত মাত্রায়। 

উদ্যোক্তারা বলছেন, ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হওয়া, সুদহার বৃদ্ধি, ডলার সংকট ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে নৈরাজ্য, প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা, গ্যাস সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কমে যাওয়াসহ বহুমুখী সংকটে বেসরকারি খাত এখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসায়ীরা গণহারে ঋণখেলাপি হবেন। তাতে দেশের ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত আরো বেশি নড়বড়ে হয়ে উঠবে।

দেশের ব্যাংক ঋণের সুদহার এখন প্রায় ১১ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সুদহারের চেয়েও অনেক নিচে নেমে এসেছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে। সর্বশেষ অক্টোবর ও চলতি নবেম্বরে ঋণ প্রবাহের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।

ব্যাংক নির্বাহীরা জানান, অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলে ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছেন না। এ কারণে ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। খেলাপি হওয়ার পথে থাকা ঋণের সঙ্গে নতুন সুদ যুক্ত হচ্ছে। বেসরকারি খাতে যে ঋণ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তার বড় অংশই অনাদায়ী সুদের সৃষ্টি। প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি খাতে নতুন ঋণের প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশের বেশি নয়।

সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। গত বছরের জানুয়ারিতেও দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দর হিসাবে দিলেও প্রতি ডলার ১২৬ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। যদিও ঘোষিত দরে দেশের কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২৭-১২৮ টাকাও আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সে হিসাবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। আর কার্ব মার্কেটে (খুচরা বাজার) প্রতি ডলারের মূল্য ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। বিনিময় হার নিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসিও খুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি কমার হার প্রায় ২৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে আমদানি হচ্ছে তার অর্ধেক। চাহিদা অনুযায়ী মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসে থাকছে। 

শিল্প খাতসংশ্লিষ্ট সব পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তির হার ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ কমে গেছে। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। একই সময়ে এসব পণ্যের এলসি নিষ্পত্তির হারও ১৬ শতাংশের বেশি কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তির হার প্রায় ৩৭ শতাংশ কমেছে। 

দেশের একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা বলেছেন, কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের অনেক শিল্প গ্রুপই চাহিদার অতিরিক্ত কাঁচামাল দেশে এনেছিলেন। ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমিয়ে দেয়ার পরও স্টককৃত কাঁচামাল দিয়ে শিল্পের উৎপাদন চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরই কাঁচামাল শেষ হয়ে এসেছে। এ কারণে উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে পণ্য উৎপাদন খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমও মনে করেন, নানামুখী সংকটের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আসছে। তিনি বলেন, সংকটের প্রভাবে সবকিছুর ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এটি ভোক্তাদের জন্য নতুন ক্ষতি ডেকে আনবে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ভালো নেই। এ কারণে সংকট থেকে বের হয়ে আসা কঠিন হবে।

মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার পথ সংকুচিত হয়ে আসছে। বর্তমান বাস্তবতায় প্রত্যেকটা পণ্যের দাম বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো থাকতে হবে। ডলারের প্রবাহ বাড়লে পরিস্থিতি ঠিক থাকবে, না বাড়লে সমস্যা আরো জটিল হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপির খাতায় আরো অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা যুক্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাপ রয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণ কমানো হচ্ছে। কিছু ব্যাংক খেলাপি হওয়ার যোগ্য এমন ঋণের সীমা বাড়িয়ে নিয়মিত দেখাচ্ছে। 

ডলারের মতোই দেশের ব্যাংক খাতে এখন তীব্র তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন লেনদেন মেটানোর পাশাপাশি সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ টাকা ধার করছে। গত মাসে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ধারের পরিমাণ ছিল ১০-১৫ হাজার কোটি টাকা। কোনো কোনো দিন এ ধারের পরিমাণ রেকর্ড ২৬ হাজার কোটি টাকায়ও উন্নীত হয়েছিল। চলতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধারের চাহিদা আরো তীব্র হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন,বাজারে যে ডলার সংকট রয়েছে তা যদি অব্যাহত থাকে থাকেন দেশের মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ছে। আমদানি সংকুচিত হবে। মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। যা গোটা অর্থনীতিকে বড় ধরনের সংকটে ফেলতে পারে।

https://www.dailysangram.info/post/540743