১৫ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৪:৩১

জনগণের জন্যই সংবিধান

-এ কে এম রফিকুন্নবী

 

মানুষকে আইন মেনেই চলতে হয়, চলতে হবে। বর্তমান দুনিয়ায় প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ বাস করে। যার যার দেশের উপযোগী সংবিধান তৈরি করে তার ভিত্তিতেই প্রতিটি দেশ পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও একটি সংবিধান আছে। নির্বাচন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগসহ দেশ পরিচালনার যাবতীয় বিধিবিধান এতে লিপিবদ্ধ। তার মধ্যে নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নাগরিকের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি আগে ছিল, এখনো আছে। আমরা ভোটাধিকারের সঠিক প্রয়োগ চাই। দেশে জনগণের অংশগ্রহণের প্রশাসন চাই। জনগণ যাকে ভোট দেবে, সে বা তারাই দেশ চালাবে। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে অধিকাংশ লোকের ভোট পেয়ে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা সংবিধান অনুসারে দেশ চালাবে। এটাই আইন বা সংবিধানের দাবি। কিন্তু মাঝে মধ্যেই এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়, যা দেশের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

 

সংবিধান একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। জনগণের প্রয়োজন সাপেক্ষে সংবিধান সংশোধন করা হয়। প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৭ বার কাটছাঁট হয়েছে। কোনো সময় বিভিন্ন দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে শুধু একজন ব্যক্তির জন্য সংবিধান পরিবর্তনের নজির আছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান বিচারপতি থেকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করা হয়েছে, নির্বাচন শেষে তিনি আবার প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে গেছেন। সংবিধান যেহেতু দেশের জনগণের ভালোর জন্য, তাই এটি করা সম্ভব হয়েছে। ১৭তম সংশোধনীতে মানুষের অধিকার সংরক্ষণ হয়নি। সংসদ বহাল রেখে আরেক সংসদ নির্বাচন করা দুনিয়ার ইতিহাসে আর আছে বলে আমার জানা নেই। ওই সংশোধনীসংক্রান্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তার বিচারপতির মেয়াদে স্বাক্ষর করেননি। আবার চূড়ান্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের হেরফের করেছেন। ফলে জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মুলা দিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব । ওই সময়ে আন্দোলনকারী ১৫ দল, ৭ দল এবং জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতায় সংবিধান সংশোধন করে কেয়ারটেকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।

বর্তমান সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিনা ভোটে এবং দিনের ভোট রাতে করেছিল বলে অভিযোগ আছে। এবারও ওই ধরনের নির্বাচন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও দুই-তিনজন মন্ত্রী হুঙ্কার দিচ্ছেন। যাতে বাকশাল কায়েমের পদধ্বনি শোনা যায়। বাকশালের পরিণতি আমরা চাই না। ইতোমধ্যেই তিনবারের সরকার পরিচালনা করা দল বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বাম-ডান বিরোধী দলগুলো একমত হয়ে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারে ফিরে যাওয়ার দাবি করছে এবং সার্বিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে। সরকারি দলের একগুঁয়েমির কারণে বিরোধীরা হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে। ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শ্রমিক নেতা, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী মানুষ, বিরোধী দলের নেয়া পদক্ষেপ সঠিক বলে জানান দিচ্ছেন।

সরকার ও সরকারি দলের লোকেরা সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। তারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সংবিধান কিসের জন্য। জনগণের জন্যই তো সংবিধান বা আইন। সেই জনগণ ও দেশের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। যেমনটি অতীতে হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী জনগণের টাকায় বিদেশে ভ্রমণ করে নিজেদের নেয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, জাতিসঙ্ঘসহ সব জায়গায় ধরনা দিয়েও তাদের অন্যায় আবদারে সমর্থন পাননি। তাই তাদের মুখের ভাষা গ্রামের ঝগড়ার ভাষাকেও হার মানিয়েছে। ‘কুলাঙ্গার’, ‘জানোয়ার’ বলে সম্বোধন করতেও দ্বিধাবোধ করছেন না। আবার লগি-বৈঠার হুঙ্কার দিচ্ছেন। পানিতে ডোবানো, আগুনে নিক্ষেপের কথাও বলছেন। আগুন লাগানোর নামে তারা ঘটনা ঘটিয়ে বিরোধীদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে তারা এ কাজগুলো করছেন। জনগণের পয়সায় চলা শান্তিশৃঙ্খলা বাহিনীকে বর্তমান সরকার নিজস্ব অপকাজে লাগাচ্ছে। ফলে তারা ইতোমধ্যেই বিদেশী স্যাংশনের আওতায় এসেছে। আরো স্যাংশন অপেক্ষা করছে, যা দেশের জনগণের আর্থিক ক্ষতি ও সম্মানের ক্ষতি করছে। আমাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার সবারই বদনাম হচ্ছে দেশে এবং বিদেশে।

সরকারি দলের দম্ভ-অহঙ্কারী মনোভাবের কারণে দেশে একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার বড় সোর্স গার্মেন্টশিল্পের ওপর আঘাত আসা শুরু হয়েছে। দেশের ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।

আমরা যারা সমাজের সচেতন মানুষ, তাদের আর বসে থাকলে চলবে না। আমরা দেশের ভালো চাই। জনগণের ভালো চাই। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি ভালো দেশ রেখে যেতে চাই। আমার অভিজ্ঞতা বলে, দেশে ভালো মানুষের অভাব নেই। সব দলেই ভালো মানুষ আছে। সময় এসেছে ভালো লোকদের সাহায্য করে মতামতের গুরুত্ব দিয়ে কথা ও লেখায় প্রকাশ করার। আমরা ভালো চাই দেশ ও জনগণের। আমি বা আমার দল ক্ষমতায় না থাকলে দেশ চলবে না- এ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। আপনি ১৫ বছর একনাগাড়ে বৈধ-অবৈধভাবে ক্ষমতায় থেকে দেশকে উন্নয়নের পথে পরিচালিত করেছেন বলে বুলি আওড়াচ্ছেন। তাই যদি হয়, তবে নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের অধীনে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিয়ে জনমতের স্বীকৃতিতে আবার ক্ষমতায় আসেন, দেশ শাসন করেন। আমাদের কারো আপত্তি থাকবে না।

সরকারি দলের চাঁদাবাজি, স্কুল-কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে আপনাদের সোনার ছেলেরা ধর্ষণের সেঞ্চুরি পালন করে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছে। মহিলা কলেজ থেকে মেয়েদের জোর করে বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দিয়ে টাকা কামাই করা একটি পেশায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির দেশ হিসেবে ইতোমধ্যেই আমরা খ্যাতি অর্জন করেছি। লাখকোটি টাকা পাচার করে ব্যাংকগুলোকে আপনার লোকেরা খালি করে ফেলেছে। ডলারের দাম হুহু করে বেড়েই চলেছে। ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে।

দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, বিদেশে টাকা পাচারকারীদের রুখে দেয়ার জন্যই একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে সৎ, যোগ্য লোকদের সরকার গঠন এখন সময়ের দাবি। সংবিধানের ধোঁয়া তুলে আর প্রতারণা করা যাবে না। দেশের মানুষ সুযোগ পেলেই সৎ, যোগ্য লোককে নির্বাচিত করে আনবে, ইনশা আল্লাহ। সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

আবারো জোর দিয়ে বলতে চাই, দলমত-জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সৎ ও যোগ্য লোকেরা এগিয়ে আসুন। জনগণের কাছে সাহস করে আপনার কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরুন। জনগণ আপনার কাজের মূল্যায়ন করেই আপনাকে ক্ষমতায় আনবে অথবা ক্ষমতা থেকে সরাবে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। এ দেশের মানুষ ক্ষমা করতে জানে। আপনি জনগণের কাজ করলে কেন আপনাকে জনগণ পেটাবে বা দেশছাড়া করবে। ক্ষমতা গেলে আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ আমাদের সংবিধানে আছে। তাই সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের দাবি অগ্রাহ্য করা যাবে না। ন্যায্য দাবি মেনে স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন।

ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ, আমেরিকা, জাপান, চীনসহ আমাদের দেশের উন্নয়ন সহযোগীরা সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর অফিসে তালা দেয়া, মিটিং-মিছিলে বাধা দেয়া, হত্যা, গুম বন্ধ করা, অবৈধভাবে বিরোধীদের জেলে ভরা থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ দিচ্ছে।

অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে নিজেরা পদত্যাগ করে সংবিধানের আওতায় কীভাবে নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা যায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। আমাদের হাইকোর্টের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। সব দল-মত-ধর্মের নেতৃস্থানীয়দেরও পরামর্শ নিয়ে সামনে এগোতে হবে। ইতোমধ্যেই দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। হরতাল-অবরোধ যাতে না দিতে হয়, সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

দেশ আপনার-আমার সবার। সবাইকেই তার কাজের হিসাব দিতে হবে। দুনিয়াতে জনগণের কাছে দিতে হবে, আবার আখিরাতে তো আল্লাহর কাছে হিসাব দিতেই হবে। তাই জীবন থাকতেই আসুন, অতীতের কাজের আত্মসমালোচনা করে সামনে এগোই।

সুজলা-সুফলা দেশটাকে আমরা ভালো পথে পরিচালিত করতে পারলে দেশের ১৮ কোটি মানুষ ভালো থাকবে। দেশ ও দুনিয়ার কাছে আমাদের সম্মান বাড়বে। ঋণখেলাপির বদনাম আমাদের থাকবে না। আর যারা দেশের লাখকোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের ধরতে হবে। টাকা ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। টাকা ফেরত এনে দেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিলে দেশেরও লাভ হবে। দেশের মানুষ কাজ পাবে। বিনিয়োগকারীরও লাভ হবে। নতুন প্রজন্মের ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর সমন্বয় করেই এ পথে এগোতে পারলে ভুলের মাশুল আদায় হয়ে যাবে। জনমনে স্বস্তি ফিরে আসবে।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

 

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/791476