১৪ নভেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:০৯

বিরোধীদের নিধনে নতুন কৌশল!

-ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম

 

বাংলাদেশের রাজনীতিকে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল। সামাজিক সুবিচার, নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা আজ অস্তমিত প্রায়। সর্বত্র আশঙ্কা, ভয়, ত্রাসের বিস্তার করে বিভাজনের মাধ্যমে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে তারা মরিয়া। চক্রটি ইতোমধ্যে হত্যা-গুম, নির্যাতন ও হয়রানির মাত্রা চরমে নিয়ে গেছে।

অ্যাডলফ হিটলার তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে কাল্পনিক শত্রু সৃষ্টি করতে হবে। দেখাতে হবে যে, দেশ বিপদাপন্ন। এতে জনসাধারণ ভীত হয়ে পড়বে। জনগণ ভীত হলে তাদের দাসে পরিণত করা সহজ।’ বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সেই আদর্শই যেন অনুসরণ করছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও সংবিধান প্রণেতা থমাস জেফারসনের কথাটা ছিল এমন, ‘একজন মানুষ যখন পদের (ক্ষমতার) জন্য তীব্র আকাক্সক্ষী হয়, তখন তার আচরণে পচন ধরে।’ জেফারসন যেন আজকের এবং তার সময়ের রাজনীতিবিদদের কথা বলছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন সেই জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন সরকারের জুলুম-নির্যাতন, বঞ্চনা, অপমান আর লাঞ্ছনার শিকার।
মানুষের ভোটাধিকার ছিনতাই, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, লুটপাটের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ প্রতিটি নাগরিক। জনবিচ্ছিন্ন সরকার এখন জনগণকে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। জেফারসনের ভাষায়, ‘যখন সরকার জনগণকে ভয় পায়, তখন সেটি স্বাধীনতা’ আর ‘জনগণ যখন সরকারকে ভয় পায়, তখন এটা নিষ্ঠুরতা ও নিপীড়ন এবং জনগণের স্বাধীনতা, অধিকার ও জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন লড়াই।’

নাগরিকের অধিকার কোনো ব্যক্তির দয়া নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সবচেয়ে বেশি হরণ করেছে। প্রতিনিয়ত লুণ্ঠিত হয়েছে মানবাধিকার।

পৃথিবীতে মানুষের মৌলিক অধিকার সবচেয়ে বেশি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে হিটলার ও মুসোলিনীর অক্ষশক্তির নৃশংসতা ও বর্বর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে; যাতে দূষিত হয়েছে বিশ্ব। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা যেন সেই ইতিহাসকেও ম্লান করে দিচ্ছে। এখন বাংলাদেশে যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে সন্ত্রাস, হত্যা, গুম-খুন, জুলুম-নির্যাতন, লুণ্ঠন, রাহাজানি গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে। দেশের নিরীহ মানুষ এখন অসহায় সময় অতিক্রম করছে।

জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া বর্তমান সরকার গায়ের জোরে দেশ শাসন করছে। তরুণ সমাজ ১৫ বছর তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। এ সরকার কখনো বিনা ভোটে, কখনো গভীর রাতে আবার কখনো বিশৃঙ্খলা তৈরি করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। বাংলাদেশ এখনো কাগজে-কলমে গণপ্রজাতন্ত্রী হলেও এটি একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে রূপ নিয়েছে। দেশের গণতন্ত্র এখন পুলিশের বুটের তলায় úিষ্ট। তাই ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনে হাহাকার থেকে মুক্তির নেশায় মুক্তিপাগল মানুষরা এখন রাজপথে। মানুষ আজ জীবন দিয়ে তার সন্তান-সন্ততি, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য পথে নেমেছে।

গত দু’টি জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন প্রশাসন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করেছে, এবারো সেই আলামত স্পষ্ট। কিন্তু সম্প্রতি গুম-খুনের অভিযোগের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র র্যাব ও এর সাতজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এবার সরাসরি প্রশাসনকে এই কাজে ব্যবহার করতে পারছে না সরকার।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলগুলো রাজধানী ঢাকায় মহাসমাবেশ করে। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে হরতাল-অবরোধসহ গণতান্ত্রিক উপায়ে অহিংসভাবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু সরকার অতীত অপকর্মের কারণে বিরোধীদের আন্দোলনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
বিগত ১৫ বছরের বেপরোয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে এ জনবিস্ফোরণ অব্যাহত থাকলে আসন্ন নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় সরকার এবার গণজাগরণ দমনে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো নগ্নপন্থা বেছে নিয়েছে।

কয়েক দিনে বেশ কিছু গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর প্রধান টার্গেট জামায়াতের কর্মীরা। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সারা দেশে জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মীদের অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা একই স্টাইলে খুন করেছে। গুপ্তহত্যার শিকারদের মধ্যে কয়েকজন চিকিৎসকও রয়েছেন।

ঘটনাগুলোর ধরন ও হতাহতদের পরিচয় লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের সবাই জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মী। হত্যাকাণ্ডের বিবরণ থেকে এসব খুনের মোটিফ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে। গণমাধ্যম ও হতাহতদের পরিবারের বরাতে পাওয়া তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে গা শিউরে ওঠে।

চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর রাত ৭টা থেকে ৮টার দিকে হত্যার শিকার হন রাজশাহীর পল্লী চিকিৎসক এরশাদ আলী দুলাল। তিনি জামায়াতের কর্মী ছিলেন। তাকে হত্যার আগে রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানার পারিলা ইউনিয়নের কৃষ্টগঞ্জ বাজারে নিজ চেম্বার থেকে ৭-৮ জন লোক একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। রড ও ধারাল অস্ত্রের আঘাতে তাকে হত্যা করে শাহ মাখদুম থানার সিটিরহাট এলাকায় লাশ ফেলে যায় খুনিরা। ওই দিন রাজশাহীর আরেক চিকিৎসক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: গোলাম কাজেম আলী খুন হন। রাতে চেম্বার শেষ করে বাসায় ফেরার সময় রাত পৌনে ১২টায় তার মোটর সাইকেলের গতিরোধ করে ৭-৮ জন খুনি। তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে ফেলে রেখে যায়। পরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। ছাত্রজীবনে ডা: কাজেম রামেকের শিবিরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৩ নভেম্বর খুন হন লালপুর উপজেলার বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদ রানা। ওই দিন রাতে ডিবি পরিচয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নেয়া হয়। তাকে নির্যাতনের পর মৃত ভেবে গোপালপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজে ফেলে যায়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১১টায় তার মৃত্যু হয়। একই ধারাবাহিকতায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ভোলার ইলিশা ইউনিয়নের জামায়াত সমর্থক অটোচালক শফিকুল ইসলাম। সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা মহবুবুর রহমানকে স্থানীয় বাজারে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হচ্ছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। এর মধ্যে গুরুতর আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ফজলুর রহমানকে ২৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টায় নলডাঙ্গা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে আহত করে সন্ত্রাসীরা। ৪-৫ জন হেলমেটধারী চাইনিজ কুড়াল ও চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার দুই পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। এর আগে একই উপজেলায় ২৫ অক্টোবর নরশৎপুর ওয়ার্ড জামায়াত নেতা পল্লী চিকিৎসক আলাউদ্দিনের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় হেলমেটধারী সন্ত্রাসীরা। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে নলডাঙ্গার ভট্টপাড়া মসজিদের ইমাম নুরশাদ আলীর ওপর হামলা চালিয়ে তার হাত ভেঙে দেয় হেলমেটধারী সন্ত্রাসীরা। গত ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরীর ভদ্রা এলাকায় রাজশাহী কলেজের এক ছাত্রের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এ সময় তার তলপেটের নাভি থেকে গলা পর্যন্ত চাপাতি দিয়ে কেটে ফেলে সন্ত্রাসীরা। একই দিনে নাটোরের নলডাঙ্গা উপেজেলায়র খাজুরা ইউনিয়নের জামায়াতের আমির মোশাররফ হোসেনকে মাইক্রো বাসে তুলে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত ও পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়া হয় এবং মৃত ভেবে সাধনাগর বিলে ফেলে দেয় সন্ত্রাসীরা।

৩০ অক্টোবর রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানা এলাকার আমানা হাসপাতালের সামনে থেকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চিকিৎসক মো: রাজু আহমেদকে। ২৮ অক্টোবরের ঢাকার সমাবেশ থেকে ফেরার পথে দাগনভূঞা উপজেলার দুধমুখা বাজার এলাকায় সন্ত্রাসীরা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াত সেক্রেটারি মো: ইয়াকুবকে বেধড়ক মারধর করে তার মাথা ফাটিয়ে, হাত ও পা ভেঙে দেয়।

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বরাবর উদ্বেগ জানিয়ে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বুদ্ধিজীবী ও নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশে বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার ও নির্বাচনী পরিবেশ ও সহিংসতার বিষয়গুলো তারা গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছেন। সহিংসতাকে অগ্রহণযোগ্য বলেও তারা বিবেচনা করেন। এর আগে দেশটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনের প্রাক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে জানিয়েছে। এমতাবস্থায় সঙ্কট উত্তরণে দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিককে আজ জেগে উঠতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/791232