বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপর পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেফতার এবং হত্যা গুমের উপর দেশ বিদেশের সংবাদ মাধ্যমসমূহে গত প্রায় ১৫ বছর ধরে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের প্রাচীন ও বহুল প্রচারিত দৈনিক গার্ডিয়ান, টাইমস ম্যাগাজিন, নিউইয়র্ক টাইমস, দি ইকনমিস্ট এই গ্রেফতার নির্যাতনের বহু মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেছে। আলজাজিরা বিশেষ ফিচার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং কিভাবে সরকারি নির্দেশে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী পুলিশের সহায়তায় বিএনপি জামায়াতের নেতকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশী করে গ্রেফতার ও শারীরিক নির্যাতন করছে, টার্গেটভুক্ত ব্যক্তিকে না পেয়ে তার স্ত্রী সন্তান, বৃদ্ধ পিতামাতাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করছে তাদের রিপোর্টে এর পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, বৃটিশ পার্লামেন্ট, কানাডিয়ান পার্লামেন্ট, অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার অবস্থার অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তার প্রতিকার দাবি করেছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এসব গ্রেফতার নির্যাতন ও রিমা-ের বেলায় দেশী বিদেশী কোনও প্রতিবাদ বা দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান, শিষ্টাচার বা নৈতিকতার প্রতিও ভ্রুক্ষেপ করা হচ্ছে না। পক্ষান্তরে সরকার ও সরকারিদল নির্যাতনকারী পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এজন্য বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করছেন। এমনকি আদালতে গিয়ে মানুষ ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকারে শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিচারকরা স্বাধীনভাবে কোনও রায় দিতে পারেন না বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে ২০১০ সালে আইন পেশায় নবীন আইনজীবীদের খোশ আমদেদ জানানোর জন্য সুপ্রীম কোর্ট বারের মিলনায়তনে আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, “ The Magistracy turns into an extension of the Police. In early’s days magistracy was not so. Magistrates were the real friends of the people whose liberties were at stake. The situation is getting worse.” অর্থাৎ নিম্ন আদালতের বিচারক তথা ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ পুলিশের সম্প্রসারিত রূপে পরিণত হয়েছে। আগে এটা ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেটরা বন্দী ও নিপীড়িত ব্যক্তিদের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। এখন পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে। যত বড় আসামীই হোক বিচারকের কাছে তিনি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ এবং নির্দোষ হিসাবে তার সাথে আচরণ করতে হয়। আবার আইনের চোখে সবাই সমান। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র কোন ব্যক্তিকে তার অপরাধ স্বীকার বা নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য বাধ্য করতে পারেন না।
আমাদের পুলিশ বাহিনী এবং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা প্রতিনিয়ত এই আইন লংঘন করে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পুলিশী রিমা-ে নিচ্ছেন। তারা যে আইন জানেন না তা আমি বিশ^াস করতে পারি না। তাদের চাকরিপূর্ব অথবা চাকরি উত্তর মৌলিক প্রশিক্ষণে এই আইন শেখানো হয়েছে এবং তা লংঘনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বিচারকের কাজ ও ক্যাডার কর্মকর্তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণের সাথে আমি দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত ছিলাম। পুলিশের অনুরোধে বিচারকরা আসামীর রিমা- মঞ্জুর করতে পারেন এটা সত্য। কিন্তু এ কাজটিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পুলিশের অনুরোধ রক্ষা করতে হলে তাকে ১৮৯৮ সালের অপরাধ আইনের বিধানগুলো হুবহু পালন করতে হয়। পুলিশ বিচারক উভয়ের জন্য এটা ফরজ। দুঃখের বিষয় এই আইনের অবশ্য পালনীয় Procedure গুলো পুলিশ বিচারক কেউই মানেন না। রিমা- মঞ্জুরির বেলায় বিচারককে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার ডায়েরী বা রোজনামচা পরীক্ষা করে দেখতে হয়। তারা তা মেহেরবাণী করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখেন না। তারা পুলিশকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেন পুলিশ সত্তর থেকে একশ বার পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। এ কেমন আদালত? দুনিয়ার ইতিহাসে এটা বিরল। গ্রেফতারকালীন সময়ে থানা হাজতে, কোর্টে চালান দেয়ার আগে পরে পুলিশ লাঠি, রাইফেলের ব্যাট-বাটন এমন কি লৌহার রড দিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের পিটানো ও নির্যাতন কোন আইনে করেন তা আমি খুঁজে পাইনি। কয়েক সপ্তাহ আগে জামায়াতের একজন সিনিয়র ও বর্ষীয়ান নেতা আদালতের সামনে তার উপর নির্মম নির্যাতনের যে কাহিনী বর্ণনা করেছেন তা শুনে অশ্রু সংবরণ করতে পেরেছেন এমন পাষাণ হৃদয় ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। এই অবস্থা আমাদের জন্য মর্মান্তিক শুধু নয় অপমানকরও। ফিলিপাইনের জাতীয় বীর ড. রিজালের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, “why liberty if the slaves of today become the tyrants of tomorrow?” এই অবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য এবং মানুষ না জাগলে এই পরিবর্তন আসবে না।
এখন একটু অতীতে ফিরে যেতে চাই। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ জনাব জয়নুল আবদীন ফারুককে বিভিন্ন জাতীয় দাবিতে হরতালে অংশগ্রহণের ‘অপরাধে’ হারুনুর রশীদ নামে একজন পুলিশ কর্মকর্তা নির্মমভাবে প্রহার করেছিলেন এবং তাকে সর্বোচ্চ পুলিশ খেতাব ও প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত করায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, আবার এই কর্মকর্তার ডিউটি এরিয়াতেই ছাত্রলীগ কর্মীরা তখন বিশ্বজিৎ নামক একজন দর্জিকে পিটিয়ে ও চাপাতি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছিল। তিনি চেষ্টা করলে তাকে বাঁচাতে পারতেন কিন্তু বাঁচাননি। তার এই পদক পাওয়া নিয়ে দেশব্যাপী যখন প্রতিবাদের ঝড় উঠে তখন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম. আলমগীর পরিষ্কারভাবে জানান যে, জনাব হারুন তার দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বিরোধী দলীয় চীফ হুইপ জনাব জয়নুল আবদিন ফারুকের অপরাধমূলক তৎপরতায় বাধা দেয়ার পুরস্কার হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন। বলাবাহুল্য, ২০১১ সালের ৬ ও ৭ জুলাই আঠারোদলীয় জোটের দুদিনব্যাপী হরতালের প্রথম দিনে মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ জনাব ফারুক পুলিশের হাতে বেপরোয়া মারধরের শিকার হন। পুলিশের লাঠির আঘাতে হুইপের মাথা ফেটে যায় এবং তার শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে যখম হয়। পুলিশ তার গায়ের শার্ট ছিঁড়ে ফেলে এবং প্রাণভয়ে পালাতে গিয়েও তিনি পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাননি। তার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেন ঐ সময়ের তেজগাঁ জোনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জনাব হারুনুর রশীদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছে।
জনাব হারুন ছাড়াও পুলিশের আরো ৬৬ জন কর্মকর্তা ঐ সময়ে পদক পেয়েছেন এখনো পাচ্ছেন। তাদের নির্বাচনের মাপকাঠি হারুনের মতো হয়ত একই হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে। তবে এখানে একটি বিরাট প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জয়নুল আবদিন ফারুক বিরোধী দলের চীফ হুইপ। তার উপর পুলিশ যে নির্যাতন করেছে তা এতই নির্মম, বেপরোয়া ও গুরুতর ছিল যে, চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হয়েছে এবং কয়েক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিতে জনাব ফারুক ভিআইপি না হলেও তার ভোটার এবং দেশবাসীর দৃষ্টিতে তিনি একজন ভিআইপি। ভিআইপিরা বিশেষ পাসপোর্ট পান এবং তিনিও পেয়েছেন। যারা জনাব হারুনকে পদকের জন্য সুপারিশ করেছেন তারা বলেছেন যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ ভিআইপিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, তিনি বিরোধীদলীয় চীফ হুইপকে পেটানোর যে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তাও তাকে পদক দেয়ার পেছনে বিবেচ্য বিষয় ছিল। সরকারের এই অবস্থান বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, সরকারদলীয় ভিআইপিদের নিরাপত্তা বিধান এবং বিরোধীদলীয় ভিআইপিদের নির্যাতন ও নিরাপত্তাকে বিঘিœত করার ব্যাপারে পারঙ্গম পুলিশ কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের যোগ্য, অন্যরা নয়। কেউ কেউ বলছেন যে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই তথ্য এই যোগ্যতা অর্জনে পুলিশ কর্মকর্তাদের বেপরোয়া করে তুলবে এবং তুলছে। তারা বিরোধী দল এবং সাধারণ মানুষের উপর যত বেশি নির্যাতন করতে পারবে তত বেশি তাদের পুরস্কার প্রাপ্তির দুয়ার খুলে যাবে। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এখন হচ্ছেও তাই। এই বাহিনীতে এখন পদোন্নতি ও প্রাইজ পোস্টিং-এর মূল মানদন্ডই হচ্ছে বিরোধী দল দমন, তাদের উপর নির্যাতন, হামলা-মামলায় তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা। এই সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনী রিমান্ড ও নির্যাতনের যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ইতিহাসে তার নজীর বিরল। আবার গ্রেফতার ও রিমান্ডের নামে পুলিশের একটি শ্রেণী হাজার নয়, লক্ষকোটি টাকার বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়েছে। গ্রেফতারকৃতরা তাদের ঘুসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে যে, একটি স্বাধীন দেশে পুলিশের আচরণ কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে গত ৪ বছর ধরেও এদেশের মানুষ কোনও কিছু উপলব্ধি করতে পারছেন বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ আমলে শুধু পুলিশ নয়, লাল পাগড়ীধারী চৌকিদাররাও মানুষের কাছে সাক্ষাৎ আতঙ্ক ছিল। পাকিস্তান আমলে মানুষ চৌকিদারদের ব্যাপারে কিছুটা হালকা হতে পারলেও পুলিশদের ব্যাপারে তত হালকা হতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে এসে পুলিশ বাহিনী অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও ব্রিটিশ আমলের চেয়েও মানুষের কাছে ভয়ঙ্কররূপে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়। তাদের একটি অংশ এখন প্রকাশ্যে ঘুস খায়। মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে ঘুস নিয়ে দর কষাকষি করে। মানুষকে গরু-ছাগলের মতো পেটায়। আদালত চত্বরে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে। সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে।
পুলিশ কর্মকর্তাদের আচরণবিধি :
দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন হচ্ছে সরকারের দায়িত্ব। পুলিশের কাজ হচ্ছে আইন- শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করা। মানুষের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান করা। অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা। এ জন্যে তাদের বেশ কিছু আচরণ বিধি মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশেও পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি আচরণবিধি রয়েছে। এই আচরণবিধিতে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রাথমিক দায়িত্বাবলী বিধৃত আছে। এতে পরিষ্কারভাবে বলা রয়েছে যে, পুলিশ বাহিনী হচ্ছে সরকারের প্রতিনিধি এবং তাদের অবশ্য অবশ্যই আইনের কাঠামো ও পরিধির মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে সমাজ বা সাধারণ মানুষের সেবা। তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা। নিরপরাধ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শান্তি রক্ষা এবং সকল মানুষের স্বাধীনতা, তাদের আইনগত সমতা এবং ইনসাফ নিশ্চিত করা। কোন পুলিশ কর্মকর্তা অথবা পুলিশ কনস্টেবল কর্তৃক মানুষকে পেটানোর অধিকার বাংলাদেশের কোন আইন, সংবিধান অথবা পুলিশের আচরণবিধিতে নেই। The International Association of Chief’s of Police নামে একটি সংস্থা আছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী এই সংস্থার সদস্য। এই সংস্থাটি পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি আচরণবিধি তৈরি করেছে। এই বিধিতে নয়টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর একটি অনুচ্ছেদে বল প্রয়োগের কিছু কথা আছে। এতেও বলা হয়েছে যে, একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালনকালে কখনো কোন পরিস্থিতিতেই সাধারণ মানুষের উপর বল প্রয়োগ করতে পারবেন না। তাদের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করতে হবে এবং তারা আলাপ-আলোচনা, দর কষাকষি এবং বিবাদ মীমাংসায় সম্মানজনক পদ্ধতির অনুসরণ করবেন। তবে এসব পদ্ধতি ব্যর্থ হলে বল প্রয়োগ যদি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে তাহলে এমনভাবে তা করতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনও প্রকার যন্ত্রণার শিকার না হন।
বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার উপর পর্যাপ্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই সংবিধানের ৩১ ধারায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার; ৩২ ধারায় জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩৩ ধারায় গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ, ২৭নং ধারায় আইনের দৃষ্টিতে সমতা, ৩৬ ধারায় চলাফেরায় স্বাধীনতা, ৩৭ ধারায় সমাবেশের স্বাধীনতা, ৩৮ ধারায় সংগঠনের স্বাধীনতা এবং ৩৯ ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এই মৌলিক অধিকারগুলোর অধিকতর সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতকগুলো আন্তর্জাতিক দলিলে স্বাক্ষর করেছে। এই দলিলগুলো হচ্ছে-
Apartheid;
এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রটি প্রণিধানযোগ্য। এই ঘোষণায় নির্যাতনের একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সংজ্ঞাটি হচ্ছে যে, কোন কাজ যা দৈহিক ও মানসিকভাবে তীব্র বেদনাদায়ক ও কষ্টকর যা ইচ্ছাকৃতভাবে বা কারো প্ররোচনায় কোন ব্যক্তির উপর আরোপ করা হয়।
কোন ব্যক্তি কোন অপরাধ করেছেন অথবা করেছেন বলে সন্দেহ রয়েছে সে সম্পর্কে তার কাছ থেকে কিংবা তৃতীয় কোন পক্ষের কাছ থেকে তথ্য বা স্বীকারোক্তি আদায়ের লক্ষ্যে তাকে অথবা অন্য কাউকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা এবং তার বা তাদের উপর পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক দৈহিক ও মানসিকভাবে তীব্র বেদনাদায়ক, কষ্টকর কিল-ঘুষি বা অন্য কোন আঘাত হানা হলেও তা নির্যাতন বলে গণ্য হবে। জাতিসংঘ ঘোষণার ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন প্রকার দুর্নীতিতে লিপ্ত হবেন না এবং তারা সর্বদা এ ধরনের কাজের বিরোধিতা করবেন এবং তা দমন করবেন।
উপরোক্ত ঘোষণা ও নীতিমালাগুলোর আলোকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কিছু কর্মকর্তার আচরণ বিশ্লেষণ করলে হতাশ না হয়ে পারা যায় না। একটি স্বাধীন দেশে যাদের খাজনার পয়সায় তাদের সংসার চলে, বেতন-ভাতা হয় তাদের উপর তাদের নির্যাতন, লাঠিপেটা, বিষাক্ত রাসায়নিক স্প্রে এবং এমনকি তাদের হত্যা, হত্যায় সহযোগিতা কোন সভ্য দেশে কল্পনা করা যায় না। আবার সরকারের মন্ত্রীরা যখন তাদের আচরণকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন এবং তাদের অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি না দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করেন তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। এই অবস্থায় জনপ্রতিরোধ ছাড়া সমস্যার সমাধান হতে পারে বলে মনে হয় না। এ দেশে যদি সুকৃতির প্রতিষ্ঠা এবং দুষ্কৃতির অবসান ঘটাতে হয় তাহলে দেশের মালিক জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সদস্য ও কর্মকর্তাই দুষ্কৃতিকে লালন করেন না। তাদের মধ্যে অনেক ভালো কর্মকর্তাও রয়েছেন। সরকারের চাপে তারা নিরপেক্ষ ও আইনানুগভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। যারা সোচ্চার হয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগের সহযোগী হিসেবে সরকারি দলের ঠেঙানো বাহিনীর ভূমিকা পালন করছেন তাদের চিহ্নিত করা দরকার এবং আমি মনে করি এ ধরনের কর্মকর্তা ও তাদের নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র মামলা হওয়া উচিত। এতে তাদের অপরাধের শাস্তি আজ না হলেও কাল হবার পথ সুগম হবে। পাশাপাশি নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও গোচরীভূত করা দরকার। এ কাজগুলো যদি দেশবাসী করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই দেশটি সভ্য মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে।