১৩ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার, ৯:৩৪

কার কাছে বিচার চাইবেন জালালের স্ত্রী?

 

নয় বছর বয়সী জান্নাতুল বাকিয়া মরিয়মের চোখের কোণে জল। নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখছে স্বজনদের আনাগোনা। স্বজনদের কেউ কেউ তার হাতে খাবার দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর পর সেগুলো সে খাচ্ছে। কখনো দৌড়ে গিয়ে চাচাদের বলছে বাবার কাছে নিয়ে চলো, বাবাকে দেখবো। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের স্ট্রেচারে রাখা বাবার নিথর দেহের কাছে গিয়ে বাবা, বাবা বলে ডাকছে। বাবা কথা না বলায় চাচাদেরকে জিজ্ঞেস করছে বাবা কথা বলে না কেন? চাচারা নিশ্চুপ থাকায় দৌঁড়ে গিয়ে তার মাকেও একই কথা বলছে। সদ্য পিতৃহারা সন্তানের এমন কথা শুনে তার মা নার্গিস পারভিন বুকফাটা আর্তনাদ করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরছেন আর কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন। একটু হুঁশ ফিরলেই বলছেন- এর বিচার কার কাছে চাইবো? গাজীপুরে চলমান পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান জালাল উদ্দিন (৪০)। আইসিইউতে মৃত্যুবরণ করার পরে তার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয় মর্গে।

একদিকে পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করছিল আর অন্যদিকে জালালের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের কান্নায় ভারী হয়ে আসে মর্গ এলাকা। এমন দৃশ্য দেখে সেখানে উপস্থিত অনেকেই শোকাহত হয়ে পড়েন। 

বেতন বাড়ানোর দাবিতে গত মাসের ২৩ তারিখ থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। গত মঙ্গলবার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্তু শ্রমিকরা তাতে সন্তুষ্ট হননি এবং সেটি মেনে নেননি। পরের দিন বুধবার থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা ফের বিক্ষোভ শুরু করেন। কোনাবাড়ী, জরুনসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভে নামেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এ সময় শ্রমিকেরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পরে পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ওইদিন ওই ঘটনায় অন্তত ১০ জন শ্রমিক আহত হন। তাদের মধ্যে পোশাক শ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মারা যান। এ ছাড়া পুলিশের গুলিতে জালাল উদ্দিনও আহত হন। প্রথমে তাকে গাজীপুরের স্থানীয় হাসপাতাল, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে অবস্থা অবনতির দিকে গেলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন চিকিৎসকরা। পরে সেখানেই জালাল মৃত্যুবরণ করেন। 

জালালের স্ত্রী নার্গিস পারভীন বলেন, কেন আমার স্বামীকে এত গুলি করা হলো? গুলি করে তাকে ঝাঝরা করে দিয়েছে। নিরপরাধ স্বামীটাকে তারা বাঁচতে দিলো না। কি অপরাধ ছিল তার? সেতো শ্রমিক নেতা ছিল না। আন্দোলনেও যায়নি। তার পদবি সুপারভাইজার। সবসময় কারখানার ভেতরে থাকতো। তার বেতনও বেশি ছিল। যারা আন্দোলন করছে তাদের বেতন কম। এই আন্দোলনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। কিন্তু তারা আমার একটা মাত্র সন্তানকে এতিম করে দিলো। এখন আমার মেয়েটা কাকে বাবা বলে ডাকবে। কান্না করতে করতে নার্গিস বলেন, ওরা শুধু আমার স্বামীকে গুলি করে ঝাঝরা করেনি। আমার বুকটাও ঝাঝরা করে দিছে। আমার বুকের যন্ত্রনা কাকে বুঝাবো। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো। বাসার সামনেই গুলি করা হয়েছে তাকে। আমার জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। পোশাক কারখানার মালিকরাই পুলিশ এনে গুলি করিয়েছে। নার্গিস যখন কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিলেন তখন তার পাশে বসেই তার মায়ের সঙ্গে কান্না করছিল মরিয়ম। সে এবার গাজীপুরের একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার বাবা যেদিন গুলিবিদ্ধ হন তখন মায়ের সঙ্গে সে স্কুলে ছিল। তার বাবাই মাকে ফোন দিয়ে বলেন, আমার গুলি লেগেছে, তোমরা বাসায় চলে আসো।  

স্বজনরা জানান, মৃত জালাল উদ্দিন (৪০) গাজীপুরের জরুন এলাকার ইসলাম গ্রুপের সুইং সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন। তার বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাঁশহাটি গ্রামে। তিনি ওই এলাকার চান মিয়ার ছেলে। জরুন এলাকার ফজল মোল্লার বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকতেন তিনি। জালালের সহকর্মী সফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন আমরা দুজন একসঙ্গে আমাদের কর্মস্থলে যাই। কারখানায় গিয়ে জানতে পারি বিক্ষোভের কারণে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তখন আমরা বাসায় ফেরার জন্য রওয়ানা হই। ফেরার পথেই পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে জালালের শরীরের বিভিন্ন স্থানে। জালালের স্ত্রীর ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অন্যান্য দিনের মতো সকাল ৮টায় কারখানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন জালাল। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে গ-গোল হতে পারে এমন আশঙ্কায় কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। বাসা কাছে থাকায় সে বিক্ষোভের এক পাশ দিয়ে আসার চেষ্টা করে। ঠিক তখন তার গায়ে গুলি লাগে। তিনি বলেন, জালাল ওই প্রতিষ্ঠানে সুপারভাইজার হিসাবে চাকরি করতেন। এমনিতেই তার বেতন ২০ হাজার টাকার উপরে। এই আন্দোলনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু নিরপরাধ এই মানুষটাকে মরতে হলো। এখন কার কাছে বিচার দিবো। কে এই বিচার করবে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাই। তিনি বলেন, জালালের সঙ্গে সর্বশেষ কথায় সে আমাকে বলেছিল তার যদি কিছু হয় তবে যেন তার মেয়েটাকে দেখে রাখি। 

জালালের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি দুবাই থাকি। শনিবার রাতে হঠাৎ খবর পাই ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। আমি জানতাম কিছুটা উন্নতির দিকে যাচ্ছে শরীর। হঠাৎ করেই দেশে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দেশে চলে আসি। এসে দেখি আমার ভাই আর বেঁচে নাই। আমাদের বাবা নাই। ঘরে বয়স্ক মা। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে জালাল ছয় নম্বর। স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে আমার ভাই জড়িত ছিল। ৮/৯ বছর ধরে তিনি ঢাকায় থাকেন। তিনি বলেন, আমার চার সন্তান। তাদের সঙ্গেই আমার ভাইয়ের সন্তানকে বড় করবো। গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=83257