৭ মে ২০১৭, রবিবার, ১০:১৫

দেশজুড়ে এবার রাজস্ব স্ট্যাম্প জালিয়াতি

একসময় দলিল রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প দরকার হতো। তখন এ ধরনের স্ট্যাম্প জাল করার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। এ জালিয়াতি রোধ করার জন্য সরকার স্ট্যাম্পের পরিবর্তে নগদ টাকা চালানের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি পদ্ধতি চালু করলে এ ধরনের জালিয়াতি রোধ হয়। কিন্তু ক্ষান্ত হয়নি জালিয়াতচক্র। এবার রেভিনিউ স্ট্যাম্প নিয়ে জালিয়াতি চরম আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু চক্র সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে জাল রেভিনিউ বা রাজস্ব স্ট্যাম্প ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সিআইডি ও ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, তারা রাজস্ব স্ট্যাম্প জালিয়াতির বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পর তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সে তথ্যের সূত্র ধরে আরো কয়েকটি চক্র ধরার চেষ্টা চলছে। জাল টাকা শনাক্তের জন্য দেশে অনেক উদ্যোগ চোখে পড়লেও জাল স্ট্যাম্প শনাক্তের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জালিয়াতচক্র এ কাজে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই কয়েকটি বড় বড় চক্র নিজেরাই প্রেস স্থাপন করে সেখানে এসব স্ট্যাম্প ছাপাচ্ছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা জানতে পেরেছে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা উত্তোলনের জন্য প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প প্রয়োজন হয়। এ স্ট্যাম্পগুলোর মূল্য পাঁচ টাকা ও ১০ টাকা। আরো বেশি দামের স্ট্যাম্পও আছে। সাধারণ কাগজ দিয়ে এসব ছাপা হয়। এগুলোর মধ্যে কোনো সিকিউরিটি সিল থাকে না। ফলে সাধারণ মানের একটি প্রেসে এ ধরনের কোটি কোটি স্ট্যাম্প ছাপিয়ে বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্র সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া নন-পোস্টাল স্ট্যাম্প, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, কপি স্ট্যাম্পও একইভাবে জাল করে তারা সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।
ডাক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ জন্য ডাক বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই। জাল স্ট্যাম্প ব্যবহার না করার জন্য তাদের কোনো সতর্কীকরণ পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। তা ছাড়া বেশির ভাগ মানুষই আসল-নকল স্ট্যাম্প চেনে না। প্রশাসন থেকেও জাল স্ট্যাম্পের ব্যাপারে খুব একটা খোঁজ-খবর নেওয়া হয় না। তাই অনেকটা নির্বিঘ্নেই স্ট্যাম্প জাল করার কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন জালিয়াতচক্র।
গত শুক্রবার এ রকমই একটি চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা কোটি টাকারও বেশি মূল্যের জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্পসহ গ্রেপ্তার করে জালকারীদের। ঢাকার কারওয়ান বাজার ও রমনা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের কাছ থেকে পাঁচ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২০০ টাকা ও ৫০০ টাকা মূল্যমানের মোট ৩৫ হাজার ১৬২টি জাল বিভিন্ন রকমের স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়; যার বাজারমূল্য এক কোটি ২০ লাখ ৭৭ হাজার ১৫০ টাকা। ডিবির জিজ্ঞাবাসাদে তারা জানায়, জাল ১০ টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রি করা হয় দুই টাকা দরে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, গত বৃহস্পতিবার থেকে কারওয়ান বাজারের ১ নম্বর সিটি করপোরেশন মার্কেট ও রমনা থানার লেভেলক্রসিং এলাকায় অভিযান চালিয়ে মো. চান মিয়া (৩৫), মো. ইকবাল হোসেন (৩১), মো. আব্দুর রশিদ (৪৫), সেলিম মিয়া (৩৮) ও রমজান মুন্সী ওরফে জামসেদকে (৪২) আটক করা হয়।
ঢাকার আশপাশে বেশ কয়েকটি জালিয়াতচক্র স্ট্যাম্প নকলের কাজে সক্রিয় রয়েছে। ৩ মে সিআইডি পুলিশ গাজীপুরের মাজুখান এলাকা থেকে এ চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা হলেন মো. ফারুক হাওলাদার (৪৫) ও তাঁর স্ত্রী মাসুমা বেগম (৩৫)। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা স্ট্যাম্প জালিয়াতি করে আসছিলেন। সিআইডি পুলিশ জাল স্ট্যাম্প ও স্ট্যাম্প তৈরির সরঞ্জামসহ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে প্রায় দুই কোটি টাকার জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়। সিআইডির সিনিয়র এএসপি আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ৩০ সদস্যের সংঘবদ্ধ একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প তৈরিতে সক্রিয় রয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনের খোঁজ পেয়েছে ডিবি। তাঁরা হলেন মানিক, নুরুল আলম মজুমদার, টিপু মজুমদার, হাসিবুর রহমান ও মো. আরিফ। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প বাণিজ্য তিন ধাপে সম্পন্ন করা হয়। একটি দল জাল স্ট্যাম্প তৈরির কাজ করে। দ্বিতীয় দলটি এগুলো বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে। তৃতীয় দলটি সরাসরি এগুলো গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কয়েকটি চক্র দেশের বিভিন্ন পোস্ট আফিস, আদালত, গার্মেন্ট ও কলকারখানা, সরকারি হাসপাতাল, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে এসব জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করছে। এ জন্য তারা নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ করেছে। ১০ টাকার স্ট্যাম্প দুই টাকায় কিনে তারা পাঁচ টাকায় বিক্রি করছে। তবে তাদের দলনেতাদের অনেকেই ঢাকায় থেকে স্ট্যাম্প জালিয়াতির ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
জালিয়াতচক্রের কেউ কেউ বিদেশি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় ব্যবহৃত কোটি কোটি টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প সরবরাহ করে থাকেন বলে তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে। এ ধরনের দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় ১২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬১ হাজার টাকা মূল্যের রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হয়। বিদেশি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিলের সময় এ ধরনের রেভিনিউ স্ট্যাম্প যাচাই করার সুযোগ কোনো রেজিস্ট্রি অফিসে নেই বলে নিবন্ধন পরিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। এ কারণে নির্বিঘ্নে সেখানে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হচ্ছে।
কয়েকজন দলিল লেখক জানান, শুধু রেভিনিউ স্ট্যাম্পই নয়, দলিল রেজিস্ট্রির সময় ব্যবহৃত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প নকলের কথাও বিভিন্নভাবে শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে যেকোনো দলিল রেজিস্ট্রির জন্য ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হয়। বিভিন্ন জালিয়াতচক্র এই ৩০০ টাকার জাল স্ট্যাম্প সারা দেশের রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাই বিষয়টি নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। সিআইডি পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পাঁচ ও ১০ টাকা মূল্যের রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন পোস্ট অফিসে। তাই এ ধরনের রাষ্ট্রীয় ডকুমেন্টস নকলের বিষয়ে সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাদেরই।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ডাক বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। কোনো কোনো পোস্টমাস্টার জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করে কোটিপতি হয়েছেন এমন তথ্যও জানা গেছে। অচিরেই তাঁদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযান চালানো হবে।
জানতে চাইলে ডাক বিভাগের পরিচালক (স্ট্যাম্প) মনসুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডাক বিভাগের কোনো কর্মচারী এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত না। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এ জালিয়াতি প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তি বা ইউভি ফাইবারযুক্ত কালিতে মড়া লেখা বিশেষ পেপারে স্ট্যাম্প বা রেভিনিউ স্ট্যাম্প ছাপিয়ে পোস্ট অফিসগুলোতে সরবরাহ করছে। ’ তিনি দাবি করেন, জালিয়াতচক্রের পক্ষে এ ধরনের স্ট্যাম্প তৈরি করা সম্ভব নয়।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/05/07/494764