১২ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১০:৫৫

সরকারি হিসাবেই দ্রব্যমূল্য বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে

 

নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন জ্বলছে। খরচ বাঁচাতে অসহায় মানুষ চাহিদায় কাটছাঁট করছেন। তবুও হিসাব মিলছে না। দ্রব্যমূল্যের অতিরিক্ত চাপে পিষ্ট তাদের জীবন। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও   নিম্নবিত্ত মানুষের অবস্থা একেবারেই করুণ। কোনো রকম খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই কারও কারও কাছে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অনেকের মাসিক বরাদ্দ শেষ হচ্ছে ২০ দিন কিংবা তারও কম সময়ে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যে হিসাব দেখা যায় তার বাস্তব চিত্র মেলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনকার হিসাবেও। টিসিবি’র ৩ বছরের বাজারমূল্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় সব পণ্যেরই দাম বেড়েছে। কিছু কিছু পণ্যের দাম এতই বেড়েছে যে, তা ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছুঁয়েছে।

দাম বাড়া পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- চাল, ডাল, ছোলা, আলু, পিয়াজ, রসুন, মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, ধনে, তেজপাতা, রুই, ইলিশ, গরু, খাসি, ব্রয়লার, ডিম, দুধ, চিনি, খেজুর ও লবণ। এর মধ্যে আলু, পিয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা, জিরা, চিনি, খেজুরের দাম বেড়েছে অনেক বেশি। বিশেষ করে দেশি পিয়াজের দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ, রসুন ১৪৭.০৬ শতাংশ, জিরা ১০৯.৫২ শতাংশ আর আলু ৮২.৬৯ শতাংশ দাম বেড়েছে। 

গত ১০ই নভেম্বরের টিসিবি নির্ধারিত বাজার দর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি কেজি সরু চালের দাম ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা, মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। এক বছর আগে একই তারিখে সরু চালের দাম ছিল ৬২ থেকে ৭২ টাকা, মাঝারি চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা আর মোটা চাল ৪৬ থেকে ৫২ টাকা। টিসিবি’র হিসাবে চালের দাম বৃদ্ধির হার সরুর ক্ষেত্রে ০.৭৫ শতাংশ আর মোটা চালের ক্ষেত্রে ২.০৪ শতাংশ। ২০২২ সালেও ২০২১ সালের চেয়ে এসব চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। যেখানে দেখা গেছে, সরু চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১২.৯০ শতাংশ, মাঝারি ৫.৭৭ শতাংশ আর মোটা চালের ক্ষেত্রে ৫.২৬ শতাংশ।

টিসিবি নির্ধারিত প্রতি কেজি মশুর ডালের (বড় দানা) দাম ১০৫ থেকে ১১০ টাকা, মাঝারি ১২০ থেকে ১২৫ টাকা, ছোট ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। যেটি ২০২২ সালে ছিল ১০০ থেকে ১০৫ টাকা, মাঝারি ১২০ থেকে ১২৫ টাকা, ছোট ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। মশুর ডালের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধির হার যথাক্রমে বড় দানায় ৪.৮৮ শতাংশ, মাঝারি ও ছোট অপরিবর্তিত। অন্যদিকে ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালে এসব ডালের মূল্য বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে বড় দানা ১৬ শতাংশ, মাঝারি ২০.৫১ শতাংশ, ছোট ১৮.৬ শতাংশ।

সবচেয়ে চড়া আলুর দাম। দেশে আলুর ব্যাপক উৎপাদন দেখা গেলেও বর্তমানে আলুর দাম কেজি প্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। যেটি ২০২২ সালে ছিল ২৪ থেকে ২৮ টাকা। মূল্য বৃদ্ধির হার ৮২.৬৯ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২১ সালে ২০ থেকে ২৫ টাকা। ২০২২ সালে মূল্য বৃদ্ধির হার ছিল ২২.২২ শতাংশ। প্রতি কেজি ছোলার দাম বর্তমানে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। যেটি আগের বছর ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। মূল্য বৃদ্ধির হার ৩.০৩ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ।

বর্তমানে টিসিবি নির্ধারিত প্রতি কেজি চিনির দাম ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা, লবণ ৪০ থেকে ৪২ টাকা, খেজুর ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। যা গত বছর একই সময়ে ছিল চিনি ১১০ থেকে ১১৫ টাকা, লবণ ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, খেজুর ১৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার যথাক্রমে চিনি ২৬.৬৭ শতাংশ, লবণ ৯.৩৩ শতাংশ, খেজুর ১৬.৬৭ শতাংশ। ২০২২ সালেও তার আগের বছরের তুলনায় এসব পণ্যের দাম বেড়েছিল যথাক্রমে চিনি ৩৯.২৪ শতাংশ, লবণ ১২.৩১ শতাংশ, খেজুর ২০ শতাংশ। 

অন্যদিকে ২০২২ সালে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হওয়া দেশি পিয়াজের বর্তমান বাজার মূল্য ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫০ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে ২০২১ সালের মতো পিয়াজের মূল্য অপরিবর্তিত ছিল। আর গত বছর ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হওয়া বিদেশি পিয়াজ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকায়। মূল্যবৃদ্ধির হার ১১০.৫৩ শতাংশ। ২০২১ সালে এ পিয়াজ বিক্রি হয়েছিল কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৫৫ টাকা। 

টিসিবি’র হিসাবে মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে দেশি ও বিদেশি রসুনেরও। ২০২২ সালে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি কেজি দেশি রসুনের বর্তমান বাজারমূল্য ২০০ থেকে ২২০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ১৪৭.০৬ শতাংশ। ২০২২ সালেও দেশি রসুন ২০২১ সাল থেকে ৩২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বিদেশি রসুনের বর্তমান বাজার দর ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। যেটি গত বছর একই সময়ে ছিল ১১০ থেকে ১৩০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ৪৫.৮৩ শতাংশ। একই রসুন ২০২১ সালে বাজারে বিক্রি হয়েছিল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। 

এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় কেজি প্রতি শুকনা মরিচের (দেশি) দাম বেড়েছে ৬.৬৭ শতাংশ, হলুদ (দেশি) ৩৮.৩০ শতাংশ, হলুদ (বিদেশি) ২১.৯৫ শতাংশ, বিদেশি আদা ৩৭.৫০ শতাংশ, জিরা ১০৯.৫২ শতাংশ, দারুচিনি ৭.৯৫ শতাংশ, লবঙ্গ ২৫ শতাংশ, ধনে ৬৪.২৯ শতাংশ, তেজপাতা ২৯.৬৩ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালেও এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল অনেক। সে সময় দেশি শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ, বিদেশি শুকনা মরিচ ৭৫.৯৩ শতাংশ, দেশি হলুদ ৯.৫২ শতাংশ, বিদেশি হলুদ ২৪.২৪ শতাংশ, দেশি আদা ১৭৫ শতাংশ, বিদেশি আদা ৪৫.২৪ শতাংশ, জিরা ৪২.৮৬ শতাংশ, দারুচিনি ২.৩৩ শতাংশ, লবঙ্গ ৮ শতাংশ, ধনে ৮.৩৩ শতাংশ। 

মাছ-মাংসের দামও বেড়েছে অনেক। টিসিবি’র নির্ধারিত রুই মাছের বর্তমান বাজারমূল্য ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, ইলিশ ৬০০ থেকে তার উপরে, গরু ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, ব্রয়লার ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকা, দেশি মুরগি ৫২০ থেকে ৬০০ টাকা। গত বছর এসব পণ্যের দাম ছিল- রুই ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, ইলিশ ৫০০ থেকে তার উপরে, গরু ৬৬০ থেকে ৭০০ টাকা, ব্রয়লার ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা, দেশি মুরগি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার রুই ৩৩.৩৩ শতাংশ, ইলিশ ২.৭ শতাংশ, গরু ১২.৫ শতাংশ, খাসি ১৬.৬৭ শতাংশ, দেশি মুরগি ১২ শতাংশ। ২০২২ সালেও এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল তার আগের বছর থেকে। সে সময় মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল- ইলিশ ৫.৫৬ শতাংশ, গরু ১৬.১ শতাংশ, খাসি ৯.০৯ শতাংশ, ব্রয়লার ১২.৫০ শতাংশ, দেশি মুরগি ৮.৭ শতাংশ। 

তবে এ বছর প্রতি হালি ডিমের দাম গত বছরের তুলনায় ৩.৩ শতাংশ কমেছে। যেটি ২০২২ সালে ২০২১ সালের তুলনায় ২৪.৬৭ শতাংশ বেড়েছিল। আর প্যাকেটজাত গুঁড়াদুধের ক্ষেত্রে ডানো ও ডিপ্লোমার দাম কেজিতে কিছুটা কমলেও ফ্রেশ ও মার্কসের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১.৮৮ শতাংশ ও ৮.৭২ শতাংশ। তবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে প্যাকেটজাত গুঁড়াদুধের দাম বেড়েছিল অনেক। সে সময় কেজিতে ডানোর দাম বাড়ে ২৪.৮১ শতাংশ, ডিপ্লোমা ২২.৩৯ শতাংশ, ফ্রেশ ৩৯.১৩ শতাংশ আর মার্কস ২৪.১৭ শতাংশ।

অন্যদিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম যে হারে কমেছে সে হারে কমেনি দেশের বাজারে। টিসিবি নির্ধারিত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের (লুজ) বর্তমান বাজারমূল্য ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা, সয়াবিন তেল (বোতল) ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা, পাম অয়েল (লুজ) ১২০ থেকে ১২৫ টাকা, পাম অয়েল (সুপার) ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। ২০২২ সালের তুলনায় বর্তমানে ভোজ্য তেলের দাম কমেছে যথাক্রমে সয়াবিন তেল (লুজ) ১৪.৪৯ শতাংশ, সয়াবিন তেল (বোতল) ৮.৭৭ শতাংশ, পাম অয়েল (সুপার) ৭.০২ শতাংশ। যদিও ২০২২ সালে ২০২১ সালের তুলনায় সয়াবিন তেলের (লুজ) দাম বেড়েছিল ১৬.৬১ শতাংশ। আর সয়াবিন তেলের (বোতল) দাম বেড়িছিল ১৪.৫২ শতাংশ। তবে সে সময়ও পাম অয়েলের দাম কমেছিল। 

সিলেটের একটি সরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক এনামুল হক বলেন, বাজারের সব কিছুরই দাম বেশি। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। যে টাকা বেতন পাই তা শেষ হয়ে যায় ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে। মানুষ আর পারছে না। সরকারকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়া উচিত। বেসরকারি চাকরিজীবী ফয়েজউল্লাহ বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলেও মনে হয় না। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আব্দুল খালেক নামে এক রিকশাচালক বলেন, সব কিছুরই দাম বেড়ে গেছে। মাছ-মাংস তো কিনতে পারি না এখন সবজি কিনে খাওয়াও কঠিন হয়ে গেছে। সবজির দামও বেড়ে গেছে অ

https://mzamin.com/news.php?news=83091