১২ নভেম্বর ২০২৩, রবিবার, ১০:৪৩

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ভারত অবশেষে শেখ হাসিনার পক্ষ নিল

আসিফ আরসালান

তৃতীয় দফা অবরোধ শেষ হলো ৯ নভেম্বর ২০২৩ এ। অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহল যা ধারণা করেছিলেন তাই ঘটেছে। আবার অবরোধ দেওয়া হয়েছে। এটা হবে চতুর্থ দফা অবরোধ। চতুর্থ দফা অবরোধ হবে ১২ ও ১৩ নভেম্বর রোববার ও সোমবার। মাঝখানে ১০ ও ১১ নভেম্বর অর্থাৎ শুক্রবার ও শনিবার ছুটি হওয়ায় দুই দিন অবরোধে বিরতি দেওয়া হয়েছে। এখন তাই অবরোধ হবে ১২ ও ১৩ নভেম্বর। এখন রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন চলছে এই বিষয় নিয়ে যে, এরপর বিএনপি ও বিরোধী দলসমূহ কী প্রোগ্রাম দেবে? কারণ সকলেই ধারণা করছেন যে, ১৪ বা ১৫ নভেম্বরের অর্থাৎ মঙ্গলবার ও বুধবারের মধ্যে যে কোনো একদিন দ্বাদশ পার্লামেন্ট নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। গত ৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের সব সদস্য প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ দাখিল করেন। সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন যে, ইসির কার্যকলাপে প্রেসিডেন্ট সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার অনুমতি দিয়েছেন। বঙ্গভবন থেকে ফিরে সিইসি ঘোষণা করেন যে, এখন যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। এর আগে থেকেই জল্পনা চলছিল এবং এখন সেই জল্পনা আরো জোরদার হয়েছে যে, সম্ভবত ১৪ বা ১৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। 

রাজনৈতিক মহলে এই মর্মে আরো জল্পনা চলছে যে, এবার তফসিল ঘোষণা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী সময় হবে ২ মাস। অতীতে সাধারণত এই সময় দেওয়া হয়েছিল দেড় মাস। তফসিল দুই চার দিন আগে হোক আর পরে হোক, শীঘ্রই ঘোষিত হতে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে নির্বাচন ১৫ জানুয়ারির দুই চার দিন আগে হোক বা পরে হোক, নির্বাচনের তারিখও ঘোষিত হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সংবিধান মোতাবেক আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কারণ ঐ দিন বর্তমান পার্লামেন্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিলুপ্ত হবে। 

এখন রাজনৈতিক মহলের মাঝে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি হলো, তফসিল ঘোষণার পরেও কি এই রকম অবরোধের কর্মসূচী চলতে থাকবে? তিন দফা অবরোধ হয়ে গেল। আজ রোববার থেকে চতুর্থ দফা অবরোধ শুরু হচ্ছে। আগের তিনটি সফল অবরোধ এবং একটি সর্বাত্মক সফল হরতাল দিয়েও সরকারকে বিরোধী দল তাদের দাবি মানতে বাধ্য করতে পারেনি। বরং পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল হয়েছে। সকলেই জানেন যে, ২৮ অক্টোবর যে প্রচন্ড পুলিশী অভিযান চালিয়ে বিএনপির ১৫ লক্ষ লোকের জনসভা পন্ড করা হয়েছে সেটি ছিল সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত একটি অভিযান। সেই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল বিরোধী দলসমূহ বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের ওপর সর্বাত্মক ক্র্যাকডাউন। আজকাল অবশ্য মার্কিনী ইংরেজিতে ক্র্যাকডাউনের পরিবর্তে লেখা হচ্ছে ডাবল ডাউন। ডাবল ডাউন বলতে নাকি ক্র্যাকডাউনের চেয়েও কঠোর দমননীতি বোঝায়। 

তো সেটা ক্র্যাকডাউন হোক বা ডাবল ডাউন হোক, আওয়ামী সরকার ২৮ অক্টোবরের রাত থেকেই সেই ডাবল ডাউন শুরু করেছে। সারা দেশব্যাপী শুরু হয়েছে বেপরোয়া ধরপাকড়। ইতোমধ্যেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এমরান সালেহ প্রিন্স, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহ্জাহান ওমর বীর উত্তম, খায়রুল কবির খোকন, বরিশালের সাবেক মেয়র মুজিবুর রহমান সরোয়ার, সামসুজ্জামান দুদু, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মধ্যম সারির নেতৃবৃন্দ এবং তৃণমূল কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী থেকে আমীর ডা. শফিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী মহাসচিব মাওলানা রফিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তরের আমীর সেলিম উদ্দিনসহ কয়েক শত নেতা ও কর্মী গ্রেফতার হন। এখন বিএনপির সামনে এমন জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, একটি কর্মসূচী পালন করার পর পরবর্তী কর্মসূচীর অনুমোদন নেওয়ার জন্য লন্ডনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এখন যারা পরীক্ষিত নেতা ও কর্মী তাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আরেকজন স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য প্রাক্তন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ক্র্যাকডাউনের দিন অথবা তার দুই একদিন আগে ইন্ডিয়া গেছেন। উদ্দেশ্য, তার দাদার কবর জিয়ারত। এই লেখাটি শুরু করেছি বৃহস্পতিবার রাতে। শুক্রবার পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরে এসেছেন কিনা সেটি জানা যায়নি। এছাড়া সব ধরনের গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। এরমধ্যে কয়েক শত নেতাকর্মী রয়েছেন জামায়াতের। 

॥ দুই ॥

হরতাল বিএনপির, অবরোধও বিএনপির। কিন্তু রাজপথ দখল করে বসে আছে মূলত বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ এবং যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মীরা। ২৮ অক্টোবরের ক্র্যাকডাউন এখনও চলছে। সরকার ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ঢাকা তো দূরের কথা, জেলা উপজেলাও নয়, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির যারা সক্রিয় কর্মী তাদেরকেও গ্রেফতার করা হবে। ইতোমধ্যেই বিএনপি ও জামায়াতের যত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার ফলে বাংলাদেশের সমস্ত জেলখানাতে আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না। জাতীয় দৈনিকসমূহে তথ্য এবং পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের সবগুলো জেলখানার যে ধারণক্ষমতা রয়েছে বাস্তবে বন্দীর সংখ্যা তার দ্বিগুনেরও বেশি। এখন হাজার হাজার বন্দীকে মেঝেতে শুতে দেওয়া হয়েছে। আদালত কক্ষে মির্জা আব্বাস বলেছেন যে, তাকে মেঝেতে শুতে দেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী এবং অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। তার তো ডিভিশন পাওয়ার কথা। 

কেন এই নির্বিচার ধরপাকড়? সেটিও সরকার গোপন করেনি। ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা কোনোরূপ রাখঢাক না করে বলেছেন যে, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াতকে রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হবে না এবং বাস্তবেও তাই করা হচ্ছে। যারা গ্রেফতার হয়েছেন তারা তো জেলখানায়। আর যারা সময়মতো গ্রেফতার এড়াতে পেরেছেন তারা আত্মগোপনে গেছেন। সকলের কি আর আত্মগোপনের জায়গা আছে? পত্র পত্রিকাতেই খবর আসছে এবং ছবি ছাপা হয়েছে যে, মফস্বলের নেতাকর্মীরা রাতের বেলায় মাঠে এবং প্রান্তরে মশারি টাঙ্গিয়ে  ঘুমাচ্ছেন। যিনিই পুলিশের নজরে পড়ছেন তাকেই তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমন একটি অবস্থায় অবরোধ বলুন আর হরতাল বলুন, সেজন্য পিকেটিং করবে কে? 

সমগ্র পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বিধি হলো এই যে, যারাই হরতাল বা অবরোধ ডাকবে সেই হরতাল ও অবরোধের সপক্ষে পিকেটিং করা তাদের সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার। পক্ষান্তরে হরতাল বা অবরোধের বিরোধিতা করবেন যারা তাদেরও সেই বিরোধিতা করার পূর্ণ অধিকার থাকবে। পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য শাখা যথা বা বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের কাজ হবে হরতাল বা অবরোধ ডাকার পক্ষ এবং তার বিরোধী পক্ষ যেন কোনো ভায়োলেন্স বা সহিংসতায় জড়িয়ে না পড়েন। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? সরকারের সমস্ত বাহিনী (সেনাবাহিনী ছাড়া) নেমে পড়েছে। শান্তিরক্ষার পরিবর্তে কাউকে পিকেটিং করতে দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আরো অবাক ব্যাপার হলো এই যে, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনীও কেউ হেলমেট পরে, কেউ হেলমেট ছাড়া, লাঠিসোঁটা বা দেশীয় অস্ত্রসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে একজোট হয়ে বিএনপি জামায়াতকে হয় পেটাচ্ছে, না হয় আটক করছে। 

॥ তিন ॥

টেলিভিশন এবং সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের সর্বাত্মক এবং সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও জনগণ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না অথবা দরকারী কাজ পায়ে হেঁটে বা রিক্সাযোগে সারছেন। বিগত ১৫ দিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আওয়ামী লীগের সাথে না থেকে নিরপেক্ষ থাকতো, আর যদি বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা রাস্তায় বের হতে পারতো তাহলে আওয়ামী লীগ ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হতো। নিজেদের এই দুর্বলতা আওয়ামী সরকার বুঝতে পেরেছে বলেই সমস্ত রাষ্ট্রশক্তিকে বিএনপি তথা বিরোধী দলসমূহের গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ক্রাশ করতে মাঠে নামিয়েছে। 

॥ চার ॥

এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে, এমন একটি ত্রাসের রাজত্বের পটভূমিকায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ন্যায্য প্রশ্ন, তফসিল ঘোষণার পরও কি সরকারের এই জুলুম পীড়ন এবং গণগ্রেফতার অব্যাহত থাকবে? কিন্তু সেটি তো হওয়ার কথা নয়। এই সরকারই বলেছে যে, তফসিল ঘোষণার পর তারা শুধুমাত্র রুটিন কাজ করবে। জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ইত্যাদি সমস্ত নির্বাচনের কমিশনের অধীনে চলে যাবে। কিন্তু সেই কাজটি আওয়ামী লীগ করবে বলে মনে হয় না। কারণ ২০১৮ সালের নির্বাচন, যেটি মিডনাইট নির্বাচন নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছে, সেই সময়ও তফসিল ঘোষণার পরে আরো বেশি করে বিরোধী দলের ওপর দমননীতি ও জুলুমের স্টিম রোলার চালিয়েছে। অথচ সেবার বিরোধী দলসমূহ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তার পরেও জুলুম পীড়নের হাত থেকে তাদের নিস্তার ছিল না। 

এবার তো আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি এই যে, ইলেকশন পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতকে আর রাস্তায় বের হতে দেওয়া হবে না। তাহলে ঢক্কানিনাদে প্রচারিত ফ্রি ও ফেয়ার অর্থাৎ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিভাবে? এই ভয়ঙ্কর ত্রাসের রাজত্বে বিএনপি জামায়াত তথা বিরোধী দলসমূহ তাদের এক দফা দাবি, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন কিভাবে আদায় করবে? একটি কথা পরিষ্কার যে, ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন যে, কোনো দেশ বা ইউনিয়নের ঐসব বিবৃতি বা নসিহতকে তারা পাত্তা দেন না। পাত্তা যে দেন না সেটা তো তাদের বিগত ১৫ দিনের কাজ কর্মেই বোঝা যাচ্ছে। 

বিএনপির পরবর্তী কৌশল কী হবে আর গণতান্ত্রিক বিশ্বই বা অতঃপর কী ভূমিকা নেবে সেই বিষয়টি এই লেখার সময় পর্যন্ত অস্পষ্টতার অন্ধকারে চাপা পড়েই থাকছে। 

এই লেখা যখন প্রেসে দিয়েছি তখন একটি নতুন কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। গত ১০ অক্টোবর শুক্রবার দিল্লীতে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শংকর এবং অমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন প্রশ্নে দুই দেশ একমত হতে পারেনি। ভারত যা বলেছে সেটি শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থনের পর্যায়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে তাদের আগের ভূমিকায় অটল থাকে। এ সম্পর্কে আগামী রোববারের কলামে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। 

Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.info/post/540423