১১ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১০:৫৭

কারাগারে ঠাঁই নেই ॥ ১২ দিনে ১০ হাজারের বেশি গ্রেফতার

 

গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনার পর সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযানে বিএনপি-জামায়াতের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের তথ্য অনুযায়ী গত ১২ দিনে সারাদেশে ১০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে। এছাড়াও আরও অনেককে আটকের পর তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী নেতা-কর্মীদের গণগ্রেফতারের কারণে কারাগারে এখন ঠাঁই নেই অবস্থা। কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮ কারাগারে এখন ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুনের বেশি বন্দী রয়েছে বলে কারা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর এখন ‘গ্রেফতার ঝড়’ বয়ে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। 

এদিকে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে জানা গেছে, গত ২৫ অক্টোবর থেকে ৯ নবেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে দলটির ১ হাজার ৯৭৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসময় নিহত হয়েছেন ৩ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ৪০০ জন। গুপ্ত হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছেন ১৬ জন। পুলিশ পায়ে গুলী করেছে দ্ ুজনকে। এছাড়াও ৯ নবেম্বর বিকাল ৪টা থেকে ১০ নবেম্বর দুপুর ১টা পর্যন্ত সারাদেশে জামায়াতের ৪১ নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন বলে জানা গেছে।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের পর বিএনপি ও জামায়াত সারাদেশে একদিনের হরতাল এবং দুই দফায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এরপর ইউনির্ফমধারী এবং সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধী নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়িতে অভিযান চালায়। নেতা-কর্মীদের না পেয়ে কোথাও কোথাও তাদের স্বজনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ আছে। যাদের ধরে নেয়া হচ্ছে তাদের নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির করা হয় না এমন অভিযোগও আছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে দিনের পর দিন গোয়েন্দা দফতরে রাখা হয় বলে জানান আটকদের স্বজনেরা। 

প্রিয়জনের খোঁজ না পেয়ে আত্মীয় স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। নিরীহ এমন অনেকে আছেন যাদের আটক করা হয়েছে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছলও নয়। আদালত চত্বরে ঘুরে কয়েক দিনে এমনই দৃশ্য দেখা গেছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপি নেতা-কর্মীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহিংসতার পর বিএনপির সমাবেশ পন্ড হয়ে যায়। এরপর গ্রেফতার করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। এ ঘটনায় একদিনের হরতাল ডাকে বিএনপি। এরপর সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে এবং মির্জা ফখরুলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এছাড়াও তাদের যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরাও এই অবরোধ পালন করে। পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও আলাদা করে এই ৪৮ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। এর আগে ৩১ অক্টোবর-২ নবেম্বর পর্যন্ত টানা অবরোধ পালন করে বিএনপি-জামায়াত। হরতালের দিন সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। হরতালের পর একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে টানা ৩ দিনের অবরোধ কর্মসূচি দেয় বিএনপি-জামায়াত। ওই কয়েকদিনে মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ও ইমরান সালেহ প্রিন্সসহ বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিএনপির মহাসমাবেশ, হরতাল, অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাসে আগুন ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। প্রতিদিনই রাজধানীতে বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছেন। যার প্রভাব পড়েছে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দী থাকায় হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। চাপ সামাল দিতে অনেক বন্দীকে গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কারা অধিদপ্তরের ৫ নবেম্বরের হিসাবে দেশে ৬৮টি কারাগারের বন্দী ধারণক্ষমতা ৪৩ হাজারের কম। তাতে রয়েছেন প্রায় ৮৮ হাজার বন্দী। বন্দীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। সারা দেশে সাধারণ আসামীর পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। আদালত তাদের কারাগারে পাঠাচ্ছেন। ফলে কারাগারে বন্দী বাড়ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, তখন কারাগারে বন্দী ছিলেন ৭৭ হাজারের মতো। কারা অধিদপ্তরের হিসাবে, এখন বন্দীর সংখ্যা ওই সময়ের চেয়ে ১০ হাজার ৬০৯ জন বেশি। ৪২ হাজার বন্দীর ধারণক্ষমতা থাকলেও আমরা কারাগুলোতে ৯০ হাজার বন্দী রাখতে পারব। তাই আপাতত ধারণক্ষমতা বাড়ানোর দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমরা পরে ব্যবস্থা নেব। 

এদিকে বৃহস্পতিবার দ্যা গার্ডিয়ানের এক খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই। গত দুই সপ্তাহে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রায় ১০,০০০ বিরোধী দলের নেতা, সমর্থক ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই হাজার হাজার অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দী কয়েক মাস ধরে এই সেলের ভিতরে রয়েছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে ডজন ডজন, সম্ভবত শত শত ফৌজদারি অভিযোগ রয়েছে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা প্রায় চার হাজার। সেখানে বন্দীর সংখ্যা এখন ১৩,৬০০ ছাড়িয়ে গেছে। জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, হাসিনা এবং তার আওয়ামী লীগ দল টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর উপর নির্মম দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়াচ্ছে। খুব কম লোকই বিশ্বাস করে যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু বা গণতান্ত্রিক হবে। বিএনপি বলেছে, যতদিন হাসিনা দায়িত্বে থাকবেন, ততদিন তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন না।

জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই রয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা এবং অনেক নেতা-কর্মী। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ১ নবেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন, কারাগারে বিএনপি নেতা-কর্মীদের দুর্দশা এখন চরমে। তিনি বলেন, বিএনপির যেসব নেতা একসময় মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ছিলেন, তাদেরও ডিভিশন দেওয়া হচ্ছে না। দিনের বেলায়ও তাদের সেলের ভেতরে আটক রাখা হয়। রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, সারা দেশে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর এখন ‘গ্রেফতার ঝড়’ বয়ে চলেছে এবং তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কেউই এর বাইরে থাকছেন না। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেয়া হচ্ছে না। একাত্তরের পরিস্থিতি বিরাজ করছে এখন দেশে। এভাবে সারা দেশকে বিএনপিশূন্য করে নির্বাচনের নামে তামাশা করবে তারা। নির্বাচন কমিশন শেখ হাসিনার তালিকা অনুযায়ী বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করবে, অনলাইন ব্রিফিংয়ে বলছিলেন রিজভী।

https://www.dailysangram.info/post/540386