৭ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:১৬

গ্যাস ও ভ্যাট নিয়ে তেলেসমাতি

|| হারুন-আর-রশিদ ||

এসরকার প্রতিনিয়ত বলছেÑ আমরা গণবান্ধব। রঙিন চশমা পরে তাকালে সবই রঙিন মনে হয়। সরকারের চোখে মনে হয়, রঙিন চশমা। দুর্ভোগ কাকে বলে এবং কত রকম, তা বোঝে শুধু দুর্ভোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীই। আমরা দুর্ভোগে আজ ক্যান্সার রোগীর মতো আক্রান্ত। মানুষের ‘পকেটের স্বাস্থ্য’ যদি ভালো না থাকে তাহলে শারীরিক ও মানসিক দু’দিক থেকেই অসুস্থ থাকে। ‘বর্তমান সঙ্কটের মধ্যে সবচেয়ে বড়’ সঙ্কট গ্যাস। এই গ্যাস নিয়ে চলছে তেলেসমাতি ‘এই আছে এই নেই’। রান্না বসানো হয়েছে চুলায়, হঠাৎ দেখা গেল গ্যাস নিবু নিবু অবস্থায়Ñ যেন মুমূর্ষু, গ্যাস এখন কোমায়। ঢাকায় মোহাম্মদপুরে যেখানে থাকি, সেখানে বাস্তব অবস্থা দেখে এসব লিখলাম। মিরপুরেও একই অবস্থা। ঢাকার বহু অঞ্চলে গ্যাস নেই বললেই চলে।
৪৬ বছর ধরে শাসক দলগুলোর মুখ থেকে শুনতাম, এখন আরো বেশি করে শুনি, দেশ তেল ও গ্যাসের ওপর ভাসছে। মৃত্যুর কিছু দিন আগে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হিজবুল বাহারে চড়ে সমুদ্রে সফরসঙ্গীদের উদ্দেশে বলেছিলেনÑ ‘আমাদের দেশ তেল ও গ্যাসের ওপর ভাসছে। এগুলো নিজস্ব উদ্যোগেই উত্তোলন করব। দেশটা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত অংশ বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করব। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমাদের রিজার্ভ চার গুণ বেড়ে যাবে।’ কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন।
রাজধানীর ১২ থেকে ২০ তলা ভবনে এখন আর গ্যাস থাকবে না। যেকোনো আবাসন প্রকল্পে ২০১৬ সাল থেকেই তিতাস গ্যাস সাপ্লাই দেয়া বন্ধ সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। আমার এক আত্মীয় থাকেন ঢাকায় কাটাসুর কাদেরাবাদ হাউজিংয়ে ১৬ তলা ফ্যাটবাড়ির চতুর্থতলায়। ডেভেলপার উল্লেখ করেছিল, প্রাকৃতিক গ্যাস তিতাস কর্তৃক সরবরাহ করা হবে এবং পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ সবই থাকবে। তিনি এখন বলছেনÑ ২০১১ সালে নির্মিত এই ফ্যাটবাড়িতে গ্যাস নেই, পানিও মাঝে মধ্যে থাকে না। বিদ্যুতের ‘চড়ুইপাখির খেলা’ও দেখা যায় দেড় বিঘা জমির ওপর নির্মিত বিশাল এই অট্টালিকায়। ১৫৭টি পরিবার থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ল্যান্ডলর্ড এবং আবাসন কোম্পানি। কথায় আছে, বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। যাতে ক্রেতা আকৃষ্ট করা যায়, সে রকম একটা খেলায় মেতে আছে অনেক আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ভোক্তাদের ঠকানোর মহাপরিকল্পনা চলছে দেশব্যাপী। চকচক করলেই সোনা হয় নাÑ আমরা কনজিউমাররা বিষয়টি বেমালুম ভুলে যাই বলেই অর্থ খরচ করেও প্রকৃত সুখ থেকে বঞ্চিত। আবাসন কোম্পানির চাকচিক্যের ফাঁদে পা দিয়ে ভোগান্তি ক্রয় করছি প্রচুর অর্থের বিনিময়ে। অধিক সার ও কীটনাশক দিয়ে হ্ইাব্রিড খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। আর আমরা অধিক মূল্যে এসব কিনে পুষ্টিহীনতায় ভুগছি। রোগ প্রতিরোধ শক্তি এসব খাদ্যে একেবারেই নেই বললেই চলে। জৈবসারে যেসব খাদ্য উৎপাদন করা হয় তাতে খাদ্যের গুণগত মান থাকে। চাষের মাছ ও মুরগির অবস্থাও একই। ওষুধ প্রয়োগ করে এগুলো মোটাতাজা করা হচ্ছে। দশ কেজি একটি রুইমাছকে দুই-তিনজনে ধরে কাটতে হতো। এখন একজনেই অল্প সময়ে বড় মাছ কেটে ক্রেতার হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা নেয়। ভোক্তাদের পকেট কাটার নানা কূটকৌশল চলছে দেশব্যাপী। সাধারণ মানুষেরাও যাতে সৎ থাকতে না পারে সে জন্য পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মহোৎসব চলছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে, নির্দিষ্ট আয়ে ও সৎভাবে তুমি চলতে পারবে না। অবৈধ পথে রোজগারের চেষ্টা করো। কিন্তু হালাল রুজি ইবাদতের আগের শর্ত। আমরা কয়জনে হালাল রুজি করছিÑ হিসাবে মেলালে দেখা যাবেÑ এটা ১০ শতাংশের ওপরে উঠবে না। ৯০ শতাংশ মানুষের আয়ে গোঁজামিল। এর মধ্যে বেশি মানুষ সুদভিত্তিক বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের ওপর নির্ভর করে সংসার চালাচ্ছে। সুদ বা রিবাÑ ক্ষমার অযোগ্য পাপ, যদি তওবা না করে। তওবা করে যদি আবার সুদের টাকায় সংসার পরিচালনা করা হয়Ñ তাহলে পাপের মাত্রা এই ওয়াদা খেলাপকারীর হিসাবে যোগ হয়ে দ্বিগুণ হবে।
দেশ তো ইসলামি শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত নয়। আমরা কী করব ও কোথায় যাবো এবং পরিত্রাণের উপায় কী? এ ক্ষেত্রে বড় বড় মুফতিদের বয়ান থেকে যতটুকু বুঝেছি, সেটা হলোÑ আপনি নিজে কী করছেন, কিভাবে চলছেন সেটাই বিবেচ্য; গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেকে উজাড় করে না দিয়ে সংযম ধারণ করে সংসার পরিচালনা করুনÑ তাতেই আল্লাহ বরকত দেবেন। অর্থাৎ অল্পেই সন্তুষ্ট থাকুন।
গ্যাসের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। লাখ লাখ ঘনফুট রিজার্ভ প্রাকৃতিক গ্যাস কোথায় গেল? কেউ কেউ রসিকতার সুরে বলছেÑ দাদাদের বাড়িতে চলে গেছে। নদীর পানিও চলে গেছে। ভাটির দেশের মানুষ আমরা। এই ভোগান্তির সুরাহা কোনো সরকার করতে পারবে বলে মনে হয় না। মনে হয়, ক্ষমতায় যেতে হলে এবং টিকে থাকতে হলে ভারতকে শুধু দিয়েই যেতে হবে ও যা বলবে তা সুবোধ বালকের মতো মেনে চলতে হবে। স্বার্থ ছাড়া আমেরিকা, চীন, ভারত, রাশিয়া কোনো কাজ করে না এবং করবে না। আমাদের এখন দূষণযুক্ত এবং বিপজ্জনক এলপি গ্যাসের ওপর নির্ভর ছাড়া বিকল্প নেই। মধ্যম শ্রেণীর পরিবারের সদস্যদের ১২ কেজির দুই থেকে তিনটি এলপি গ্যাসের জন্য প্রয়োজন ১০৫০´৩=৩১৫০ টাকা প্রতি মাসে। তিতাস গ্যাসে দুই চুলা লাগত। সর্বশেষ নির্ধারিত মূল্য ছিল প্রায় ৯০০ টাকা। অন্য দিকে, প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্মার্টকার্ড ছিল আরো সাশ্রয়ী। মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ টাকা প্রতি মাসে খরচ হতো স্মার্টকার্ডে। এতে সরকারের লাভ দুইভাবে। গ্যাসের অপচয় রোধ করা সম্ভব হতো; দ্বিতীয়ত গ্যাসের অবৈধ সংযোগ হ্রাস পেত। সরকার নিজেকে ডিজিটাল হিসেবে পরিচয় দিতে যেখানে গর্ববোধ করে, সেখানে স্মার্টকার্ড কেন বন্ধ করে দিয়ে এলপি গ্যাসের বহুবিধ ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে, এর পেছনে কারণ আছে। মানুষ বলছেÑ এলপি গ্যাসের ব্যবসাটিকে এখন সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট কাটার আরেকটি অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হলো। এতে সাধারণ মানুষের আরেক ধাপ কষ্ট বেড়ে গেছে।
এবার আসুন, ভ্যাট নিয়ে কিছু আলোচনা করি। ১ জুলাই ২০১৭ অর্থবছর থেকে নতুন ভ্যাট আইন সরকার চালু করতে যাচ্ছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে অতীতের ভ্যাট আইন রহিত করার চিন্তাভাবনা চলছে। নতুন অর্থবছর থেকে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর ব্যবস্থা করা হবে। নতুন এই আইন চালু হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব ধরনের সেবা খাতের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষতা হ্রাস পাবে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। যখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, তখন দেশীয় শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যায়। এতে অর্থনীতির গতিধারা শ্লথ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার এসব বিষয় নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় বলে মনে হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলেছে, আইনটি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাবান্ধব নয়। কারণ হলো, ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনাও ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
নতুন ভ্যাট আইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসাব্যয় ও শিক্ষাব্যয়, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, রেস্টুরেন্ট, পরিবহনব্যয়, ল্যান্ড ট্যাক্স এবং হোল্ডিং ট্যাক্স (পৌরকর) বৃদ্ধি পাবে। এতে সাধারণ ভোক্তাশ্রেণীর ওপর যেমন অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়বে, তেমনি তাদের ক্রয়ক্ষমতা এবং পাশাপাশি চাহিদাও হ্রাস পাবে। উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেলে উৎপাদনও হ্রাস পাবে। ফলে অর্থনীতির গোটা পরিমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা এটাও বিভিন্ন জরিপে দেখেছি, দেশীয় পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের পাশাপাশি ৪৪৭টি আমদানি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। এতে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম কমে যাবে। বিদেশী পণ্যের দাম কমে গেলে দেশীয় পণ্যের বাজার মার খাবে। এতে দেশ বিদেশী পণ্যের বাজারে পরিণত হতে পারে। সরকার কিভাবে এ ধরনের একটি বাজার সৃষ্টিতে আগ্রহী, তা বুঝে আসে না। দেশীয় শিল্পকে না বাঁচিয়ে বিদেশী পণ্যের বাজার উন্মুক্ত করে দেয়া আত্মঘাতী। উন্নয়নশীল বা উন্নত রাষ্ট্র কোনোভাবেই এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। সরকারের উচিত ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব পরিবেশ কিভাবে সৃষ্টি করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। বাংলাদেশকে বিদেশী বাজারের করিডোর বানানোর জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে ভোক্তাশ্রেণীর পাশাপাশি দুই কোটি ২০ লাখ ুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। এর পাশাপাশি, আমরা প্রিপেইড গ্যাস স্মার্টকার্ড চাই। এলপি গ্যাস বাসাবাড়িতে নিরাপদ নয়, সাশ্রয়ীও নয়।
লেখক : গ্রন্থকার

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/217926