৭ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:১৫

বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে

দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাংলাদেশের তিনটি অর্গান বা স্তম্ভ মিলে জুলে কাজ করছে না। এটি আমাদের কথা নয়, সাম্প্রতিককালে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, আইন মন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সব উক্তি করেছেন সেসব উক্তি থেকে রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব মানুষ জানতে পেরেছে। বোঝা যাচ্ছিল যে এই সমন্বয়ের অভাব দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সিনহা সম্প্রতি দুই তিনটি সমাবেশে এমন কিছু কথা বলেছেন যার ফলে সমন্বয়ের অভাব প্রকাশ্যে আসে। এর পর প্রধান বিচারপতির এসব মন্তব্যের ওপর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কিছু মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে আইনমন্ত্রীর এসব মন্তব্য আগুণে ঘি ঢালার শামিল হয়ে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি যখন অবনতির দিকে গড়াচ্ছিল তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং ভারসাম্য রক্ষার আবেদন জানান। প্রধানমন্ত্রীর এই আবেদনে উত্তাপ কিছুটা কমে আসে। কিন্তু প্রশমিত হয়নি। কারণ বিচার বিভাগের যে মূল বক্তব্য বা দাবি সেটি অপূর্ণই রয়ে গেছে। ঐ দিকে সুপ্রিম কোর্টে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার ফলে এই দেবী মূর্তি সম্পর্কিত সব দায়দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপরই বর্তায়। বিতর্কটি শুরু হয়েছিল এভাবে:

দেশে আইনের শাসন যে অনেকাংশে অনুপস্থিত সেকথা এবার স্পষ্ট বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। গত সোমবার ১ মে এক শ্রেণীর পত্রপত্রিকায় তার বক্তব্য যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে আমরা সেভাবেই সেগুলোর অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি। উল্লেখ্য যে, সবগুলো উদ্ধৃতি সোমবার ১ মে’র পত্রিকা থেকে নেয়া।
‘ডেইলি স্টার’ রিপোর্ট করেছে, “প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গতকাল বলেছেন, বাংলাদেশে আইনের শাসন সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি প্রতিবেশী দেশগুলো সফলভাবে করেছে। এমন একটি সময় ছিল যখন পাকিস্তানের আইন কানুনকে বলা হতো আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র। সেদেশেও আইনের শাসন রয়েছে। অথচ আমরা আজও সেটি করতে পারিনি। ইন্ডিয়ার কথা বাদই দিলাম, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালও এ ব্যাপারে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।” প্রধান বিচারপতি বলেন, “পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্ট নি¤œ আদালতের বিচারকদের বদলি এবং পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ বাংলাদেশে সেই নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। এই কারণেই এদেশে প্রধান বিচারপতিকে কথা বলতে হয়। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোতে এমনকি ভারতেও প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষণ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে তারা যে বক্তৃতা করেন সেগুলো মিডিয়াতে আসে না। কিন্তু এদেশে প্রধান বিচারপতিকে কথা বলতে হয় এবং সেকথা মিডিয়াতে আসে। এর কারণ একটাই। আর সেটি হলো, আমরা উন্নত দেশ এমনকি ভারতেরও সমপর্যায়ে যেতে পারি নি।
তিনি বলেন, সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্ট মাঝে মাঝে কিছু নির্দেশনা দেয়। সকলেরই উচিত সেই সব নির্দেশনা গ্রহণ করা এবং মেনে চলা। যে কোনো আইনের পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে দিয়েছে।
তিনি বলেন, মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক ছিল বলেই সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম এবং ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছে। তিনি ঘোষণা করেন যে, আইন পরিষদের পাস করা যে কোনো আইন যদি সংবিধানের মৌলিক চরিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সেই আইন বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্ট দ্বিধা করবে না।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য সংবিধানকে সংশোধন করতে পারেন। সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য কেন, সমস্ত সদস্যও যদি এমন কোনো আইন পাস করেন যেটি সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনায় মনে হয় যে এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী, তাহলে সে আইনটিও বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্ট দ্বিধা করবে না।
॥দুই॥
গত ২৬ শে এপ্রিল আইনমন্ত্রী বলেছিলেন যে পৃথিবীর কোনো দেশেই প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে এতো কথা বলেন না অথবা এমন ক্ষোভ প্রকাশ করেন না যেটি আমাদের প্রধান বিচারপতি করেন। তবে আমি মনে করি যে, তার যদি কোনো ক্ষোভ থেকে থাকে সেটি প্রকাশ্যে না বলে আমাদেরকে জানালে আমরা সেটি সমাধানের চেষ্টা করবো”। (ডেইলি স্টার ১লা মে সোমবার ২০১৭)।
দৈনিক ‘প্রথম আলো’ রিপোর্ট করছে,“ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, পাকিস্তানের মতো দেশে এখন সুপ্রিম কোর্ট যা বলে, নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলি সবকটি সুপ্রিম কোর্ট ছাড়া কেউ করে না। এটি পৃথিবীর সর্বত্র বহাল আছে, শুধু বাংলাদেশে যেহেতু থাকছে না; এ কারণেই প্রধান বিচারপতিকে বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে এটি প্রতিষ্ঠার জন্য।”
“পৃথিবীর উন্নত দেশে, এমনকি ভারতে বিচারপতিরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কথা পত্রিকায় বের হয় না, আপনাদের প্রধান বিচারপতির বক্তব্য পত্রিকায় বের হয়। তার একটাই কারণ। আমরা সে পর্যায়ে যেতে পারিনি। আমাদের আইনের শাসন আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি নি। আশ্চর্য হবেন, পাকিস্তানের সংবিধানকে আইয়ুব খানের সংবিধান বলা হতো। সে দেশে এখন যে আইনের শাসন চলছে, নিম্ন আদালতে ’৭৩ সালের পর থেকে এটি আজকে আমরা পাইনি, বাংলাদেশে এখনো হয়নি। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল অনেক ওপরে।”
প্রধান বিচারপতি বলেন, “সংবিধানই সুপ্রিম কোর্টকে আইন পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা (জুডিশিয়াল রিভিউ) দিয়েছে। এ কারণেই সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও ত্রয়োদশ সংধোধনী, যেগুলো সংবিধানের যে কোনো স্তম্ভের বিরোধী, সেগুলো বাতিল ঘোষণা করেছেন”। তিনি বলেন,“ আমরা কোনো দিনই কুণ্ঠিত হবো না। ভবিষ্যতেও যদি এ রকম কোনো আইন হয়, সংবিধানের বা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক”, হলে তা বাতিলে সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্ট পিছপা হবে না।, তিনি বলেন,“দুই তৃতীয়াংশ সদস্য বা সবাই মিলে সারা সংবিধানটাকে (স্ক্র্যাপ) বাতিল করতে পারেন, এ ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যদি দেখেন, তার (সংবিধান) মূল ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আইনের শাসনের প্রতি আঘাত আসছে, তাহলে আমরা বলব ততটুকু বেআইনি”। (দৈনিক প্রথম আলো সোমবার ১লা মে)।
দৈনিক ‘ইনকিলাবে’ রিপোর্ট করা হয়েছে, “বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান প্রণয়ন করেছেন তাতে সুপ্রিম কোর্টকে জুডিশিয়াল রিভিউ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের এই ক্ষমতাবলেই সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম, অষ্টম ও ১৩তম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে। এতে কোনো দ্বিমত নেই।” (দৈনিক ইনকিলাব সোমবার ১লা মে ২০১৭)
দৈনিক ‘সংগ্রামে’ রিপোর্ট করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা বলেছেন, বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতির কথা বেশি বের হয় এবং বেশি কথা বলতে হয়, কারণ এ দেশে আইনের শাসন নেই। অন্যান্য দেশে প্রধান বিচারপতিরা এতো কথা বলেন না, কারণ সেসব দেশে আইনের শাসন রয়েছে। কিন্তু আমাকে বলতে হয়, আমার কথা বেশি বের হয়, কারণ এখনো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি।
সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন কোনো আইন বাংলাদেশে হতে দেয়া হবে না। এমন কোনো আইন করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, জনগণের অধিকার ক্ষুণœ করে সংবিধানে এমন সংশোধন করা হলে তা বাতিল করে দেবেন সুপ্রিম কোর্ট। আপনারা তিন চতুর্থাংশ বা একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিলে সারা সংবিধানটাকে স্ক্র্যাপ করতে পারেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট যদি দেখে তার মূল ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আইনের শাসনের প্রতি আঘাত আসছে, ইনডিপেনডেন্স অব জুডিশিয়ারিতে আঘাত আসছে, জনগণের ফান্ডামেন্টাল রাইটস যেসব অধিকার রয়েছে সেগুলোতে আঘাত আসছে তাহলে আমরা ততটুকু বেআইনি বলে দেব।” (দৈনিক সংগ্রাম সোমবার ১লা মে ২০১৭)।
॥ তিন॥
বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের বাদানুবাদ এখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে চলেছে। শুধু এখন নয়, সেই পাকিস্তান আমলে দেখেছি এবং বাংলাদেশ আমলের সাড়ে চার দশকে দেখলাম, একটি জেনুইন ইস্যু পেলেই সরকার বা বিরোধী দল নির্বিশেষে সেটি নিয়ে কথা বলে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়। এটি দোষের কিছু নয়, বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতিতে। যেভাবে চীফ জাস্টিসের মতো সম্মানীয় ব্যক্তি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছেন সেটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে খাপ খায় না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন সুপ্রিম কোর্টে দেবী থেমিসের মূর্তি নিয়ে কথা বলেন এবং বলেন যে, এ ব্যাপারে তিনি বা তার নির্বাহী বিভাগ কিছুই জানেন না তখন সব দায়দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের প্রধান হিসাবে প্রধান বিচারপতির ওপরেই বর্তায়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণে এই বিষয়টি নিয়ে আমরা আর বেশি কিছু বলছি না। কিন্তু গতকাল শনিবার নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মধ্যে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের ওপর কথা বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চাপ সৃষ্টির কারণেই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তিনি বলেন, যে দেশে বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না সেখানে গণতন্ত্র কিভাবে থাকবে? তিনি আরো বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি, যে দেশে গণতন্ত্র থাকে না, সেই দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে পারে না। সরকার বিচার বিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। এই কথাগুলো আমরা অনেকবার বলেছি, কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকে সেটা বুঝতে পারেন নি। যখন প্রধান বিচারপতি নিজেই বলছেন তখন জাতির সামনে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই দেশে এখন কোনো গণতন্ত্র নেই, বিচার বিভাগ তার স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
প্রধান বিচারপতি যা বলেছেন সেগুলো নতুন কোনো কথা নয়। বিরোধী দলের দায়িত্বশীল নেতারা অনেকদিন থেকেই এসব কথা বলে আসছেন। তবে রাজনীতিবীদদের ভাষা একরকম আর মাননীয় বিচারপতিদের ভাষা আরেক রকম। তার পরেও প্রধান বিচারপতি এতোদূরও বলছেন যে, একটি প্রভাবশালী মহল প্রধান মন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করছেন। প্রধান বিচারপতি এর চেয়ে বেশি আর কি বলবেন? প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু দেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে যে কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে সেটি গণতন্ত্র বা আইনের শাসনের সাথে খাপ খায় না। গুম, খুন, অপহরণ, বিচার বিভাগীয় হত্যাকা- গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। এগুলো করেছে হিটলার এবং মুসোলিনির ঘাতক বাহিনী, করেছে ভারতের সিবিআই এবং বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে রক্ষী বাহিনী।
বলা হচ্ছে যে, আগামী ২০১৮ সালের মধ্যেই দেশে ইলেকশন হবে। যদি তাই হয় তাহলে তার আগেই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অন্যথায় আগামী নির্বাচনও ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরিণতি ভোগ করবে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/282749-