৬ মে ২০১৭, শনিবার, ১০:১৩

ঢালাওভাবে ভ্যাট আরোপে মূল্যস্ফীতি বাড়বে

চরম বিশৃঙ্খলায় পড়বে বাজারব্যবস্থা : বিশেষজ্ঞদের মত

সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে দেশের বাজারে দেখা দিতে পারে চরম বিশৃঙ্খলা। সে সাথে ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হবে। খুচরাপর্যায়েও ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক বা ভ্যাট দিতে হবে নতুন ভ্যাট আইনে যা যুক্তিসঙ্গত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও। এই আইন বাস্তবায়ন নিয়ে সম্প্রতি শীর্ষপর্যায়ের সভায় খোদ অর্থমন্ত্রীকেই পাল্টা হুমকি দিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা।
মূল্য সংযোজন কর আইন-২০১২ বাস্তবায়ন হবে চলতি বছরের পয়লা জুলাই থেকে। অর্থাৎ আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে এর বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। মূসক আইন-২০১৬ সালের জুলাই থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতা, আপত্তি ও জটিলতার কারণে সম্ভব হয়নি। এমন কি যারা ভ্যাট আইন প্রয়োগ করবেন তাদেরও এই আইনের অস্পষ্টতা নিয়ে সন্দেহ ছিল। জটিলতা ও অস্পষ্টতা দূরীকরণের ল্েয কমিটি গঠন কিংবা নানা বৈঠক হলেও কার্যত ফলপ্রসূ কিছুই হয়নি। ব্যবসায়ীদের দু-একটি সংগঠন বাদে অন্যরা ঢালাও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের বিপ।ে এমন কি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর পক্ষ থেকেও ঢালাওভাবে ভ্যাট আদায়ের বিপক্ষে মত এসেছে। এফবিসিসিআই বলছে উৎপাদন খাতের জন্য ১০ শতাংশ এবং সেবা খাতের জন্য সর্বোচ্চ সাত শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে।
জানা গেছে, নতুন আইনে ব্যবসাপর্যায়ে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক বিক্রি (টার্নওভার) ভ্যাটমুক্ত। তবে এ জন্য হিসাবপত্র দেখাতে হবে। ৩০ লাখ টাকা থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের উপর ৩ শতাংশ এবং ৮০ লাখ টাকার উপরে টার্নওভারে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। এসব সীমা আরো বাড়িয়ে দেয়ার পে ব্যবসায়ীরা। এ দিকে নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সভাপতি আবু মোতালেব বলেছেন, এমন আইন বাস্তবায়ন করা যাবে না, যেটা হলে ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। আর ঐক্য পরিষদের সভাপতির বক্তব্যে জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, যদি আপনারা আন্দোলন করেন তবে আমরা তা দমন করব।
প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী একজন দোকানদারকেও ঢালাওভাবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। কিন্তু অনেক পণ্যে মূল্য সংযোজিত হয় না। তাহলে কেন দোকানদার ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেবে? সম্প্রতি এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের অভিমত, নতুন আইন কার্যকর করার আগে এর কিছু বিষয় বিবেচনায় আনা উচিত। ঢালাওভাবে সব ক্ষেত্রে ভ্যাট কার্যকর হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। পণ্যমূল্য উসকেও যেতে পারে। ভ্যাট আদায়ে ব্যবসায়ীদের উৎসাহী করতে এবং এটা আদায়ে কর প্রশাসনের সমতা বাড়াতে হবে। সেই সাথে বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ সর্বজনীন বিষয়ে ভ্যাট তুলে দিতে হবে। কেননা এটি সবার প্রয়োজন। আর এটি তুলে দিলে সবার ভালো হবে। দিন দিন সর্বজনীন ব্যবহারকৃত বিষয়গুলোর চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে।
তার মতে ভ্যাট আদায়ের পর তা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। ভোক্তার কাছ থেকে বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ভ্যাট আদায় করছে। কিন্তু আদায় করা ভ্যাট আসলে কি সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তাহলে তার পরিমাণ কত সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে, না হলে ভোক্তারা ভ্যাট দিতে চাইবেন না। তখন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করেও আশানুরূপ কোনো সফলতা আসবে না। এ ছাড়াও কর ফাঁকি বন্ধ করতে হলে সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এতে পণ্যমূল্যও বৃদ্ধি পাবে। এ পর্যায়ে পণ্যমূল্য ও ভ্যাট সংগ্রহ দোকানদারদের জন্য বড় বিড়ম্বনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। উৎপাদনপর্যায় থেকে শুরু করে খুচরা পর্যন্ত দফায় দফায় ভ্যাট দিতে গিয়ে ক্রেতারাও আর্থিক তির মুখে পড়বে। এতে স্থানীয় শিল্পের টিকে থাকাও কষ্টের হবে।
অন্য দিকে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে থাকা বৃহৎ কোম্পানি এসিআইর নির্বাহী পরিচালক ও মার্কেটিং ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আলমগীর বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা হলে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি দুটোই বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি হবে। ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে এবং খুচরা বিতরণব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনই বিকল্প চিন্তা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এখাতে দ জনশক্তি তৈরি হয়নি। ভ্যাট আদায়ে আরো তদারকি ও আধুনিক পদ্ধতি কার্যকরের পরামর্শ দেন তিনি।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ-গ্রিস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি সেবাখাত, শিল্প কারখানার উৎপাদন, আমদানি কিংবা রফতানি প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত। এসব খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হলে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাবে। ভোক্তাপর্যায়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ তার মতে, ঢালাওভাবে নয় বরং আগে উচিত ভ্যাট আদায়ের দুর্বল দিকগুলো বের করা। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট দেয়ার সুযোগ পান। তবে ভিত্তি হিসাব করা হয় ১৫ শতাংশ। এটি সঙ্কুচিত ভিত্তিমূল্য নামে পরিচিত। যারা রেয়াত নিতে অসমর্থ তারা এ পদ্ধতিতে ভ্যাট দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে ও ভ্যাট আদায়ের সুবিধার্থে কোনো কোনো েেত্র প্যাকেজ পদ্ধতিতে বার্ষিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভ্যাটও আদায় করা হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিল, নির্মাণ সামগ্রীসহ বেশকিছু পণ্য সেবার ওপর সঙ্কুচিত ভিত্তিমূল্যে ভ্যাট আদায় করা হয়ে থাকে। অপোকৃত ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় প্যাকেজ পদ্ধতির ভ্যাট। তবে বিদ্যমান আইনে বেশ কিছু সমস্যাও ছিল। এ কারণে নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু নতুন আইনে ঢালাওভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/217751