৬ মে ২০১৭, শনিবার, ১০:০৭

সুনামগঞ্জের হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলহানি

ঠিকাদারেরা প্রভাবশালী, বাঁধ নির্মাণে গাফিলতি

সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলহানির পর যে ঠিকাদারের নামটি বেশি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো খন্দকার শাহীন আহমদ। ফরিদপুর জেলার গোয়ালচামট এলাকার বাসিন্দা তিনি। এই ঠিকাদার সুনামগঞ্জের আটটি হাওরের নয়টি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ পেয়েছিলেন। তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় নয় কোটি টাকা। কিন্তু তিনি পাঁচটি বাঁধের কোনো কাজই করেননি। অন্য চারটি বাঁধের মধ্যে দুটির কাজ হয়েছে ২০ শতাংশ, অপর দুটির ৪০ শতাংশ। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
শুধু খন্দকার শাহীন নন, সুনামগঞ্জে ফসলহানির পর আলোচিত-সমালোচিত ঠিকাদারদের মধ্যে আরও আছে মেসার্স গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ, সজিব রঞ্জন দাস, মেসার্স নুনা টেড্রার্স, মের্সাস নূর ট্রেডিং, ম্যাম কন্সট্রাকশন, মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডার্স অ্যান্ড মো. শামীম আহসান। এসব প্রভাবশালী ঠিকাদারের কাছে পাউবো কর্মকর্তারা ছিলেন অসহায়। তাঁদের কাছ থেকে কোনো কাজই আদায় করতে পারেনি পাউবো। আবার কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাউবোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশও ছিল। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ফসলহারা কৃষকদের পক্ষে আন্দোলনে আছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবু সুফিয়ান। তিনি বলেছেন, যেসব ঠিকাদার পাঁচটা-ছয়টা করে বাঁধের কাজ পেয়েছেন, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী। তাঁরা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ পাননি। সুনামগঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার বলেন, ‘আমার জানামতে, প্রভাবশালী ঠিকাদারেরা ঢাকায় যোগাযোগ করে কাজ নিয়ে আসেন। এতে পাউবো কর্মকর্তারাও জড়িত থাকেন।’
জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন বলছেন, পাউবো এবং ঠিকাদারদের দুর্নীতির কারণেই হাওরবাসী বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বাঁধ নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতি এবার প্রথম নয়, প্রতি বছরই হয়ে থাকে। এবার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়েছে।
সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলরক্ষায় প্রতিবছরই পাউবোর অধীনে বাঁধ নির্মাণের কাজ করে ঠিকাদার এবং স্থানীয়ভাবে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। এবার ৭৬টি বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পিআইসি পায় ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকার কাজ। ঠিকাদারের কাজ ছিল নতুন বাঁধ নির্মাণ ও উঁচুকরণ। আর পিআইসির কাজ ছিল ভাঙা বাঁধের সংস্কার।
পাউবোর উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, ৭৬টি বাঁধের কাজ পেয়েছে ২৮ জন ঠিকাদার বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শুরু থেকে সুনামগঞ্জ জেলার বাইরের কয়েকজন ঠিকাদারকে নিয়ে লুকোচুরি শুরু করেন পাউবো কর্মকর্তারা। তাঁরা ওই ঠিকাদারদের সম্পর্কে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাঁদের দাবি ছিল, অনলাইনের মাধ্যমে দেশের যেকোনো স্থান থেকে দরপত্রে অংশ নেওয়া যায়। তাই সুনামগঞ্জ কার্যালয়ে ওই ঠিকাদারদের কোনো তথ্য নেই।
সুনামগঞ্জের হাওরে হাজার কোটি টাকার ফসলহানির পেছনে বাঁধ নির্মাণে পাউবো, ঠিকাদার ও পিআইসির গাফিলতি এবং অনিয়ম-দুর্নীতিই প্রধান কারণ বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, দুদক এসব অভিযোগের তদন্ত করছে। দুদক ইতিমধ্যে জানিয়েছে, বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কথা স্বীকার করেছে পাউবো।
ঠিকাদারেরা প্রভাবশালী
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফরিদপুরের ঠিকাদার খন্দকার শাহীন আহমদ একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। সম্প্রতি তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। তিনি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
পাউবোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, খন্দকার শাহীন তাঁর নয়টি কাজের মধ্যে জেলার তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর, দিরাই উপজেলার বরাম হাওরে একটি এবং দোয়ারাবাজার উপজেলার নাইন্দার হাওরে দুটি—এই পাঁচটি বাঁধের কোনো কাজই করেননি। ৮ কোটি ৮৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকার কাজের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনি ২৫ লাখ ১৯ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন।
খন্দকার শাহীন সময়মতো কাজ না হওয়ার সব দোষ দিলেন পাউবোর ঘাড়ে। প্রথম আলোর ফরিদপুর প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, পাউবো তাঁদের কার্যাদেশ দিয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর প্রি-ওয়ার্ক (কাজের আগের পরিমাপ) করতে দেরি হয়েছে। তাই সময়মতো কাজ শুরু করতে পারেননি তিনি। পাঁচটি বাঁধের কাজ করেননি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইটা তো আগেই বলেছি। সময়মতো কার্যাদেশ, প্রি-ওয়ার্ক হয় নাই।’ তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর কাজ আছে। তিনি নিজে সুনামগঞ্জে আসেননি। হাবিবুর রহমান নামের একজন প্রতিনিধি সব দেখাশোনা করেন।
গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হলেন টাঙ্গাইল জেলার আকুর-টাকুরপাড়ার মো. আফজালুর রহমান। তিনি টাঙ্গাইলের বিএনপি নেতা ও সাবেক বনমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজের আপন ভাগনে। এলাকায় একজন বড় ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত।
আফজালুর রহমান তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে তিনটি হাওরে সাতটি বাঁধের কাজ পেয়েছিলেন। এর মধ্যে তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরে একটি বাঁধের কোনো কাজই করেননি তিনি। পাউবো প্রতিবেদনে বাকি ছয়টির মধ্যে পাঁচটির অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৯০ শতাংশ, একটির ৬০ শতাংশ। তিনি ২ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকার কাজের মধ্যে এ পর্যন্ত বিল পেয়েছেন ১ কোটি ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
আফজালুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
সুনামগঞ্জের সজিব রঞ্জন দাশ পেয়েছিলেন সাতটি হাওরে নয়টি বাঁধের কাজ। নয়টি কাজের মধ্যে গুরমার হাওরে দুটি বাঁধের কোনো কাজই তিনি করেননি। বাকি সাতটির মধ্যে তিনটির ৩০ শতাংশ, দুটির ৪০ শতাংশ, একটির ২০ শতাংশ এবং অন্যটির ৫০ শতাংশ হয়েছে বলে পাউবো তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। নয়টি কাজের ৬ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার মধ্যে তিনি এ পর্যন্ত বিল পেয়েছেন ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
সজিব সুনামগঞ্জ শিল্প ও বণিক সমিতির সহসভাপতি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, পাউবো কার্যাদেশ দিতে এবং সাইট বুঝিয়ে দিতে দেরি করায় তিনি যথাসময়ে কাজ শুরু এবং শেষ করতে পারেননি। কাজে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কোনো টাকাই তো পেলাম না, তাহলে দুর্নীতি করলাম কীভাবে!’
মেসার্স নুনা ট্রেডার্সের মালিক ব্যবসায়ী মো. সাইদুল হক। ঠিকানা ১৫৪, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। এই প্রতিষ্ঠানের দুটি কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৯০ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠান বিলও পেয়েছে বেশি। ৪ কোটি টাকার কাজে মধ্যে তাদের ২ কোটি টাকার বেশি বিল দেওয়া হয়েছে। অর্ধেকের বেশি বিল পেলেন কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাবে সাইদুল হক বলেন, ‘আমাদের কাজ ৯০ নয়, ৯৫ ভাগ হয়েছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন কেউ শুরু করেনি। তাই পাউবোর প্রথম কিস্তির টাকা আসার পরই আমরা নিয়ম অনুযায়ী বিল পেয়েছি।’
মের্সাস নূর ট্রেডিংয়ের ১ কোটি ৫৯ লাখ ৬ হাজার টাকার দুটি কাজের একটি ৩০ শতাংশ, অন্যটির ৫০ শতাংশ কাজ হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান একটি কাজের বিল পেয়েছে ৮ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক এবং সুনামগঞ্জ শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি খায়রুল হুদা ওরফে চপল। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার চান তিনি। তাঁর দুটি কাজের বিষয়ে বলেন, ‘আমি কখনো পাউবোতে ঠিকাদারি করিনি। এখনো করছি না। আমি ঠিকাদারি করি সড়ক ও জনপথ বিভাগে। আমার লাইসেন্স নিয়ে অন্য দুজন দুটি কাজ করেছে। কাজ যাই হোক, এবার যে পরিমাণ ঢল এসেছে, তাতে শতভাগ কাজ হলেও হাওরের ফসলরক্ষা করা কঠিন হতো।’
মেসার্স ম্যাম কন্সট্রাকশনের ঠিকানা হলো প্লট ৩, সেকশন ২, হাউজিং এস্টেট, কুমিল্লা। মেসার্স ইব্রাহিম অ্যান্ড শামীম আহসান নামের প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন মো. বাচ্চু মিয়া। এই প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ৯৯, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা।
একেবারেই কাজ না করা আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো সিলেটের মাহিন কন্সট্রাকশন। এই প্রতিষ্ঠান টাঙ্গুয়ার হাওরে একটি বাঁধের কোনো কাজই করেনি। এবার হাওরে সুনামগঞ্জের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ঢাকার একাধিক, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার জেলার ব্যক্তি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে।
এবার সুনামগঞ্জের হাওরে বাঁধের কাজ করেছেন এমন একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি যাই বলেন করেছে প্রভাবশালী ও বড় বড় ঠিকাদারেরা। আমরা সুনামগঞ্জের ছোট ছোট ঠিকাদারেরা এখন পড়েছি বেকায়দায়। ঋণ করে, অনেক কষ্টে কাজ করেও কোনো টাকা পাইনি। এখন যে পরিস্থিতি হয়েছে, কবে টাকা পাব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
শতভাগ কাজ হয়নি কোনো বাঁধের
পাউবোর সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঠিকাদারদের ৭৬টি কাজের মধ্যে ৯টির কোনো কাজ হয়নি। ১০ থেকে ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে ১৪টির, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ হয়েছে ১৫টির, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হয়েছে ১৬টির, ৯০ শতাংশ কাজ হয়েছে ১৬টির। এ পর্যন্ত ৩৯টি বাঁধের কাজের আংশিক বিল হিসেবে ঠিকাদারেরা ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার মেসার্স নুনা ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের দুটি কাজের ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৭২ হাজার টাকার মধ্যে তুলে নিয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার। অন্য ৩৭টি প্রতিষ্ঠান ৪ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ লাখ টাকা করে বিল পেয়েছে। বাকি ৩৭টি কাজের কোনো বিল এখনো দেওয়া হয়নি।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরী বলেছেন, ‘বাঁধ নির্মাণে এবার ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, এটা পরিষ্কার। আমরা কখনো সব ঠিকাদার বা পিআইসিকে দুর্নীতিবাজ বলিনি। আমরা বলেছি, যারাই বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে।’
সুনামগঞ্জে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতেÿক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৮ কৃষক পরিবার। তবে স্থানীয় কৃষক-জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ৯০ শতাংশ ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1170391/