৬ মে ২০১৭, শনিবার, ১০:০৬

এসএসসি পরীক্ষা

উদারভাবে পরীক্ষার খাতা না দেখায় পাস কমেছে!

কয়েক বছর ধরে উদারভাবে খাতা দেখা এবং ‘ঢালাও’ নম্বর দেওয়ার যে অভিযোগ ছিল, তা অনেকটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন হওয়ায় এবার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে। তবে শিক্ষাবিদ, পরীক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকেই বলছেন, পাসের হার কমলেও পরীক্ষার খাতা সঠিক মূল্যায়নের বিকল্প নেই।
এত দিন অভিযোগ ছিল, আগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুল উত্তরের জন্য নম্বর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রান্তিক নম্বর পূর্ণ করে (কেউ ৪৭, ৪৮ বা ৪৯ পেলে ৫০ বা অন্যান্য দশকের ঘর পূর্ণ করে দেওয়া) দেওয়া হতো। সেসব চর্চা এবার সেভাবে হয়নি বলে পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, আগে পরীক্ষকেরা খাতা নিয়ে যেতেন এবং নিজেদের মতো করে মূল্যায়ন করেছেন। এতে কেউ (শিক্ষার্থী) হয়তো লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এবার সঠিক মূল্যায়ন করে সারা দেশে সমতা আনা সম্ভব হয়েছে।
এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার প্রায় ৮ শতাংশ কমে গেছে। ফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ কমেছে পাঁচ হাজার। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই সবচেয়ে খারাপ ফল। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘ঢালাও’ নম্বর না পাওয়া এবং কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার গতবারের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় সার্বিক ফল খারাপ হয়েছে।
জানতে চাইলে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, এবার যে পদ্ধতিতে খাতা দেখা হয়েছে, সেটা সময়োপযোগী। আগে খাতা দেখায় গতানুগতিকতা ছিল। আগে জ্যেষ্ঠতা দেখে প্রধান পরীক্ষক নিয়োগ করা হতো। এবার প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে প্রধান পরীক্ষক করা হয়নি। এমনকি যাঁরা পরীক্ষক, তাঁদেরও তিন দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, কুমিল্লা বোর্ডে ইংরেজি ও গণিতে ফল খারাপ হয়েছে।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরের চারজন পরীক্ষকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা আগে উদারভাবে খাতা দেখার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রধান পরীক্ষক (রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক) গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নতুন পদ্ধতি চালুসহ মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কক্সবাজারের কর্মশালায় তিনিও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে গত তিন বছরের কিছু খাতা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে দেখা যায়, কোনো কোনো পরীক্ষক খুব দুর্বলভাবে খাতা দেখেছেন। যেমন একটি খাতায় হাজী মুহম্মদ মুহসীনকে কেন দানবীর বলা হয়, তার উত্তরে একজন লিখেছে তিনি দানব ও বীর ছিলেন, এ জন্য দানবীর বলা হয়। এ জন্য পরীক্ষক নম্বরও দিয়েছেন। এ ছাড়া কোনো একজন পরীক্ষার্থী হয়তো একটি পত্রে ৭৭, ৭৮ বা ৭৯ পেল (প্রান্তিক নম্বর), সেখানে ৮০ নম্বর দেওয়া হতো। এতে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বেড়ে যেত। অন্যদিকে পাস নম্বর পাওয়ার জন্য ২-৩ নম্বর ঘাটতি থাকলে তা পূর্ণ করে দেওয়া হতো। ফলে পাসের হার বেড়ে যেত।
ওই শিক্ষক বলেন, এবারের এসএসসি পরীক্ষায় এ ধরনের নির্দেশনা ছিল না। যার যত নম্বর পাওয়ার কথা, তাকে তা-ই দিতে বলা হয়েছে। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরীক্ষকদের নমুনা মডেল উত্তরমালা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী পরীক্ষকেরা গুরুত্ব দিয়ে খাতা দেখেছেন। যে কারণে এবার ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে।
ওই কর্মশালায় পরীক্ষকদের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে বলা হয়েছিল, নতুন পদ্ধতিতে খাতা দেখা হলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পাসের হার কমে যেতে পারে। তখন মন্ত্রী পাসের হার কমলেও মানের ওপর জোর দিতে বলেন। তাঁর মতে, এবার জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এবার প্রশ্নপত্রের বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) অংশে ১০ শতাংশ নম্বর কমিয়ে তা সৃজনশীলে বাড়ানো হয়েছে। এমসিকিউ পদ্ধতিতে যেহেতু সহজেই নম্বর পাওয়া যায়, সে কারণে ফল কিছু খারাপ হয়ে থাকতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশের দিন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আগে প্রধান পরীক্ষকেরা খাতাই দেখতেন না। আবার পরীক্ষকও ঠিকভাবে দেখেননি। এ জন্য এবার সঠিকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই পরিবর্তনই কাম্য বলে মন্তব্য করেন তিনি। এতে তাঁরা বিস্মিত নন।
মাগুরার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক বলেন, প্রান্তিক নম্বর পূর্ণ করে দেওয়ার ঘটনা ৮-১০ বছর ধরেই চলে আসছিল। এবার তাঁরা এটা করেননি। আগে ‘ওভারমার্কিং’ করা হতো। এবার তা–ও হয়নি।
নতুন পদ্ধতিতে এবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপর উত্তরপত্র নিয়ে প্রশিক্ষিত পরীক্ষকদের দিয়ে মডেল উত্তরপত্র তৈরি করা হয়। পরে তার আলোকে অন্য পরীক্ষকেরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছেন। ওই সব খাতার মধ্যে আবার প্রায় ১২ শতাংশ খাতা প্রধান পরীক্ষকেরা দেখেছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে খাতা মূল্যায়নে নতুন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এর ফলে পাসের হার কিছু কমলেও সেটা খারাপভাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার যে কাজটি শুরু হয়েছে, সেটাকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। তাঁর মতে, মান ভালো না হলে শুধু পাস বাড়িয়ে লাভ নেই।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1170351/