২৪ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৭:৩৯

উল্টো ছিল ইঞ্জিন, আগের দিনই জানানো হয়েছিল ‘দুর্ঘটনা ঘটতে পারে’

ঢাকার লোকোশেডে ইঞ্জিন ঘোরানোর যন্ত্র (টার্ন টেবিল) বহু দিন নষ্ট। ঘোরাতে না পেরে ইঞ্জিন উল্টো লাগিয়ে মালবাহী ট্রেন চালানো হয়। উল্টো লাগানো ইঞ্জিনের কারণে চালকের সিগন্যাল দেখতে সমস্যা হওয়ায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে টার্ন টেবিল দ্রুত মেরামতের তাগিদ দিয়ে রোববার ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে (লোকো) চিঠি দেওয়া হয়। এর একদিন পর সোমবার ভৈরব স্টেশনের আউটারে যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর গোধূলি এক্সপ্রেসে উল্টো ইঞ্জিনের মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেছে ১৭ জনের।

তবে রেলওয়ে বলছে, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী মালবাহী ট্রেনের চালকের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটেছে। রেলের পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেনটিকে স্টেশনে আউটারে থামতে সিগন্যাল দেওয়া হয়। ট্রেনটির লোকো মাস্টার (চালক) সংকেত অমান্য করে স্টেশনে ঢুকে পড়ায় ভৈরব থেকে ঢাকামুখী যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষের তিনটি বগির সঙ্গে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কা লাগে।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, শুধু চালকের ভুলের নয়, রেলেরও গাফিলতি রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ৩০২৮ নম্বরের ইঞ্জিনে মালবাহী ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালক জাহাঙ্গীর আলম। ২০০৪ সালে চাকরিতে যোগ দেওয়া এই চালক গত ছয় বছর পণ্যবাহী ট্রেন চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে।

উল্টো করে লাগানোর কারণে ইঞ্জিনের পেছন দিক ট্রেনের সামনে থাকে। আর চালকের বসার স্থান (ক্যাব) থাকে পণ্যবাহী কন্টেইনারের কাছাকাছি। অর্থাৎ চালক সামনে বসার পরিবর্তে বগির কাছাকাছি বসে ট্রেন চালান। এতে ‘লং হুড’ সমস্যা তৈরি হয়। অর্থাৎ ইঞ্জিনের লম্বা বডি সিগন্যাল এবং চালকের মাঝে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। ফলে চালককে সিগন্যাল দেখতে হয় দূর থেকে। ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনের দৈর্ঘ্য অন্যান্য ইঞ্জিনের তুলনায় বেশি। এই ইঞ্জিনের দৈর্ঘ্য ১৯ হাজার ৬৯ মিলিমিটার বা প্রায় ৬৩ ফুট। চালকের ক্যাব বাদে দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট। ইঞ্জিন উল্টো করে লাগানোর কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ ফুট দূর থেকে সিগন্যাল দেখতে হয় চালককে।

রেল সূত্রের ভাষ্য, উল্টো ইঞ্জিনের কারণে ভৈরবের দুর্ঘটনায় একই সমস্যা ছিল। চালকের বরাতে তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, লং হুড সমস্যায় আউটারে থামার সিগন্যাল দেরিতে দেখেন। ব্রেক করতে দেরি হওয়ায় মালবাহী ট্রেনের গতি কমলেও, থামেনি।

রেলের আরকটি সূত্রের দাবি, মালবাহী ট্রেনের বগির ডিস্ট্রিবিউটর ভাল্ব (ডিভি) কাজ করেনি। চালক ইঞ্জিনের ব্রেক করলেও, ডিভি কার্যকর না থাকায় বগির ব্রেক কাজ করেনি। তাই ট্রেনটি থামেনি। ৩২ বগির চারটির ডিভি সচল পাওয়া পাওয়া গেছে দুর্ঘটনার পর। তবে সমকাল এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি।

রোববার রেলের চট্টগ্রামের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) সাজিদ হাসান নির্ঝর স্বাক্ষরিত চিঠিতে ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে (লোকো) জানানো হয়, ‘ঢাকার লোকোশেডের টার্ন টেবিলটি নষ্ট। তাই লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ঘোরানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ২৬০০, ২৯০০ এবং ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো পেছনের দিক সামনে রেখে ট্রেন চালাতে হয়। অনেক স্থানে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সিগন্যাল এবং লেভেল ক্রসিং দেখা যায় না।’

টার্ন টেবিলটি দ্রুত মেরামত করার তাগিদ দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘বিশেষ করে ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এই ঝুঁকি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে যে কোনো সময়ে সিগন্যাল ওভারশ্যুট বা লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী সাজিদ হাসান নির্ঝরের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করেননি। টার্ন টেবিল কত দিন ধরে নষ্ট- এমন প্রশ্নে তিনি টেলিফোন সংযোগ কেটে দেন। পরবর্তীতে আর ফোন ধরেননি।

এদিকে একাধিক রেল কর্মকর্তার ভাষ্য, চালকেরও ভুল রয়েছে। ভৈরব স্টেশনটি চট্টগ্রামমুখী রেললাইন থেকে নিচু। তাই স্টেশনে প্রবেশের আগে সতর্কতা হিসেবে গতি কমাতে হয়। কিন্তু চালক জাহাঙ্গীর আলম তা করেননি। আর সিগন্যাল বাতি থাকে বাম দিকে। ইঞ্জিন উল্টো করে চালালে চালকও থাকেন বাম দিকে। ফলে সিগন্যাল দেখতে না পাওয়ার কারণ নেই। বড়জোর ৫০ ফুট পর দেখতে পান।

অপরদিকে দুর্ঘটনার পর চালক, সহকারী লোকো মাস্টার ও গার্ডকে সাময়িক বরাখাস্ত করেছে রেলওয়ে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উল্টো ইঞ্জিনের বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসান সমকালকে বলেছেন, কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তে জানা যাবে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2310203539