২৩ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৬:২৪

এক যুগে ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ ২৮ হাজারেরও বেশি অভিবাসন প্রত্যাশি

মুহাম্মদ নূরে আলম: ইউরোপে কর্মসংস্থানের আশায় বাংলাদেশের তরুণদের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। আর এভাবে ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যু বা নিখোঁজের ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। ভূমধ্যসাগরে প্রতিবছর নৌকাডুবিতে প্রাণহানি ঘটে অভিবাসীদের। এসব অভিবাসীর অনেকের লাশ কখনোই পাওয়া যায় না। আবার সাগরপাড়ের বিভিন্ন দেশের উপকূলে প্রায়ই মৃতদেহ ভেসে আসে, যেগুলোর পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। গত এক দশকে ভূমধ্যসাগরে হাজার হাজার প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গত এক দশকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অন্তত ২০ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার এখনো নিখোঁজ, ধারণা করা হচ্ছে তারা চিরতরে হারিয়ে গেছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষ তিউনিশিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ২০২২ সালের তুলনায় তা ২৬০ শতাংশ বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করার সময় ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন। গত বছরের একই সময়ের মধ্যে এক হাজার ৬৮০ জন অভিবাসী নিহত বা নিখোঁজ হয়েছিলেন। এদিকে মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কুমারেরটেক বলাইকান্ডি এলাকাবাসী গত ২০ অক্টোবর মানববন্ধন করে জানিয়েছেন, ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ঘর ছেড়ে ছয় মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন মাদারীপুরের ১৭ যুবক। ১৭ যুবকদের ফিরে পেতে উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে পরিবারের। ঘুরছেন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে।  

বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ১১ হাজারেও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর ওপর জাতিসংঘের অভিবাসী-বিষয়ক সংস্থা আইওএমের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশের বিদেশ যেতে চাওয়ার কারণ হলো ভালো কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন-জীবিকার প্রত্যাশা। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঋণগ্রস্ততা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আকাক্সক্ষা, দেশে কোনো ভবিষ্যৎ না থাকা ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, ৯১ শতাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশীই জানিয়েছেন, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও মান বৃদ্ধি পেলে তাঁরা বিদেশে যাবেন না। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে যারা ইউরোপ-আমেরিকা যেতে চান, তাদের বেশির ভাগই (৬৭%) উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এক যুগের বেশি সময় ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ হয়েছে। টাকার অঙ্কে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এ দেশের শ্রমজীবী তরুণেরা নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারেন এ রকম কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি গড়ে উঠেছে? ব্যয়বহুল অবকাঠামোকেন্দ্রিক উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যেও মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে, এমনকি নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের ধারাবাহিক বিদেশ গমনের পরিসংখ্যান তো ভিন্ন কথা বলে। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন? এতো উন্নয়ন তারপরও কেন ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে আমাদের দেশের তরুণরা। এমন কি নিহতদের পরিচয় কোনো দিনই শনাক্ত করা হয়নি। এভাবেই হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ নিখোঁজই থেকে যায়। মৃতদেহ অভিবাসীদের পরিচয় শনাক্তে প্রয়োজন একটি সমন্বিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি দরকার বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, বাংলাদেশের তরুণ শ্রমজীবীদের জন্য দেশের ভেতর যত দিন পর্যন্ত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান, ভালোভাবে বাঁচার মতো মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না যাবে, তত দিন পর্যন্ত এই ভূমধ্যসাগরের পথে ঝুঁকিপূর্ণ ইউরোপ-যাত্রা বন্ধ হবে না। খবর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), আইওএম, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, ইনফোমাইগ্রেন্টস ও  ডয়চে ভেলে।

আইওএমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে এ পথ ধরে প্রবেশ করেছেন ১৫ হাজার ২২৮ বাংলাদেশি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৮৩৮। বর্তমানে ইতালিমুখী ‘বোট পিপলের’ উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রতিবেদন অনুসারে, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ পথে নৌকায় করে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালে এই পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিল ৫ শতাংশ, ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ এবং ২০২২ সাল শেষে তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা তুরস্ক, মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে প্রথমে আফ্রিকার গৃহযুদ্ধবিপর্যস্ত দেশ লিবিয়ায় যান, তারপর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির পথে যাত্রা করেন।

ইউএনএইচসিআর নিউইয়র্ক অফিসের পরিচালক রুভেন মেনিকদিওয়েলা নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, অভিবাসী ও শরণার্থীরা প্রতি পদক্ষেপে মৃত্যু ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি নিয়ে থাকে। নিউ ইয়র্কে যখন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার পক্ষ থেকে এই বক্তব্য এসেছে, একই দিনে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা সমুদ্রপথে ইটালি আসা অভিবাসল কিভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তা নিয়ে আলোচনায় বৈঠকে বসেছেন। ইইউ সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাধারণ আশ্রয় ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী সংস্কারের জন্য বছরের পর বছর ধরে আলোচনা চললেও কোনো ফলাফল আসেনি। এবারও বিভিন্ন শর্ত নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে ইটালি এবং জার্মানির মধ্যে। মেনিকদিওয়েলা নিরাপত্তা পরিষদকে মনে করিয়ে দেন যে সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো থেকে লিবিয়া এবং তিউনিশিয়ার উপকূলে আসার পথটুকু বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিবাসন রুটের একটি। তিনি বলেন, ‘সাধারণের চোখের আড়ালে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার মানুষ এরইমধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজারই এসেছেন ইতালিতে। গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাকি অভিবাসীরা এসেছেন গ্রিস, স্পেন, সাইপ্রাস এবং মাল্টায়। সবচেয়ে বেশি অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন তিউনিশিয়া থেকে। এ সংখ্যা প্রায় এক লাখ দুই হাজার। লিবিয়া থেকে এসেছেন ৪৫ হাজার মানুষ। অনেক বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, তরুণেরা দেশের ভেতরে যদি ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতেন, যদি সুন্দরভাবে বাঁচার মতো আয়ের সুযোগ পেতেন, যদি তাঁদের কর্মস্থলগুলো নিরাপদ হতো, তাহলে তাঁরা এ রকম মরিয়া হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতেন? সার্বিয়া হয়ে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণ আরাফাত রহমান অভিবাসনবিষয়ক একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে নিম্ন বেতনের কম্পিউটার অপারেটরের চাকরির জন্য বিপুল পরিমাণ ঘুষ দেওয়ার বদলে সেই টাকা খরচ করে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

২০১৯ সালে নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মারা যাওয়া সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার তরুণ খোকন আহমেদ কেন এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন? গণমাধ্যমের কাছে খোকনের ভাই লিটনের দেওয়া বক্তব্য থেকে জানা যায়, তাঁদের দোকানদার বাবা পাঁচ বেকার সন্তানের মধ্যে তুলনামূলক শিক্ষিত খোকনকে ভালো কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় দোকান বন্ধক রেখে টাকা ধার করে ইতালির পথে পাঠান। 

মাদারীপুরের ১৭ যুবক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানা গেছে, ইতালি নেওয়ার কথা বলে সৌদি আরব নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৭ যুবককে। সৌদি বিমান বন্দরে নামার পর তারা (১৭ যুবক) জানতে পারেন, ইতালি নয়, তাদের নিয়ে আসা হয়েছে সৌদি আরব। এর পর আটকে রাখা হয় একটি বন্দিশালায়। দালালদের চাহিদা মতো মুক্তিপণ না দেওয়ায় ছয় মাস ধরে খোঁজ নেই তাদের। এ ঘটনায় থানা ও আদালতে একাধিক মামলাও হয়েছে। আল-আমিন নামে মূলহোতা গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেড়িয়ে বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। এ ঘটনায় বিচার চেয়ে সম্প্রতি মানববন্ধনও করেছেন নিখোঁজদের স্বজনরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুরের বড় মেহের গ্রামের হাফিজুল ও মফিজুল শিকদার ইতালি যাওয়ার জন্য ২৪ লাখ টাকা দেন আল-আমিন নামের দালালকে। কিন্তু ২০২২ সালের ২৬ মার্চ বিমান থেকে নেমেই তারা বুঝতে পারেন এসেছেন সৌদি আরব! পরে সেখানে পুলিশে হাতে ধরে পড়ে একমাস জেল খেটে অবশেষে দেশে ফিরেন দুই ভাই। একইভাবে প্রতারণার শিকার দত্তেরহাট ও চাপাতলী গ্রামের অন্তত ১৭ যুবক। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১২-১৪ লাখ টাকা করে নেয় দালালচক্র। পরে সৌদি নিয়ে একটি ঘরে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। স্বজনদের কাছে পাঠানো মোবাইলে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, একটি কক্ষে আটক ১৫-১৭ জন যুবক। তারা দেশে ফেরার জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। আর দালালদের চাহিদামতো মুক্তিপণ না দেওয়ায় যুবকদের খোঁজ মিলছে না ছয় মাস ধরে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের ফিরে পেতে মানববন্ধন করেছেন স্বজনরা। হাফিজুল ও মফিজুল শিকদারের মা আছিয়া বেগম বলেন, আমার দুই ছেলেকে ইতালি নেওয়ার কথা। কিন্তু আল-আমিন তাদের সৌদি নিয়ে যান। পরে জেল খেটে আমার দুই ছেলে দেশ ফেরে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ১৭ যুবককে একইভাবে সৌদি নিয়ে প্রতারণ করেছে দালাল আল-আমিন ও তার লোকজন। পরে এই ঘটনার বিচার চেয়ে মামলা করেছি।

লোকমান খান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, আমাকে ইতালি নেওয়ার কথা বলে দালাল আল-আমিন আমার কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা নেন। পরে সৌদি আরব নিয়ে আমাকে অক্লান্ত পরিশ্রমের কাজ করান। পরে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন, আল-আমিন ও তার লোকজন আমাকে রেখেই পালিয়ে যান। অন্যমানুষ আমাকে অসুস্থ অবস্থায় সৌদিতে হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে আউট পাস নিয়ে দেশ ফিরে আসি। দালাল আল-আমিনের ফাঁদে পড়ে আমার সবকিছুই হারিয়েছি। এই ঘটনার বিচার চাই, আর আমার পাওনা টাকা ফেরত চাই।

নিখোঁজ ইলিয়াস বেপারীর মামাতো ভাই আলী আকবর বলেন, দালাল আল-আমিন আশা দিয়েছিলেন, ইলিয়াসকে সৌদি আরব থেকে ইতালি নেবে বলে ১২-১৩ লাখ টাকা নিয়েছেন আল-আমিন। কিন্তু ইলিয়াসকে নিয়ে যাওয়া হয় সৌদি আরব। কিছুদিন যাবার পর ইলিয়াসের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।

https://www.dailysangram.info/post/538787