২৩ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৬:১৯

নদীখেকোদের স্বার্থে কি কমিশনের চেয়ারম্যানকে অপসারণ

-মনজুর আহমেদ চৌধুরী

 

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদীখেকোদের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান নিয়েছিলেন। রাজনীতিক, প্রভাবশালী, বিত্তশালী, আমলা—যাঁরাই নদীর ক্ষতি করেছেন, তাঁদের সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। একদিন তাঁর কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন তিনি ২০ বছর আগের সঙ্গে বর্তমানের কর্ণফুলীর পার্থক্য বোঝাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামের নদীটি কীভাবে নানাভাবে দখল হয়ে গেছে এবং সেই দখলদারি কীভাবে উচ্ছেদ সাপেক্ষে নদীকে মুক্ত করা যায়, সে কথা বলছিলেন।

মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোর একটি সাক্ষাৎকারে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে বলেছেন, ‘ইউএনওরা নদী রক্ষায় যতটা না আগ্রহী, তার চেয়ে নদীর জমি ব্যক্তির নামে দিতে বেশি আগ্রহী।’ তিনি রাজনীতিকদের নদী দখল-দূষণ নিয়ে যেমন অনেক কথা বলেছেন, তেমনি বড় বড় অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন। সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসের আলোচনা বলেছেন, ‘মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে যাঁরা বালু উত্তোলন করছেন, তাঁদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারী মন্ত্রীর সম্পর্ক আছে।’ এরপর মাস না পেরোতেই কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রায় দেড় বছর বাকি থাকতেই বাতিল করেছে সরকার। নদীখেকোদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার কারণে তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দেশে নদী দখল-দূষণের সঙ্গে রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা জড়িত থাকেন। অনেক রাজনীতিক কখনো নিজেই দখলদার, বালু উত্তোলনকারী, নদী দূষণকারী। যেসব ক্ষেত্রে নিজেরা এমন কাজে জড়িত নন, সেসব ক্ষেত্রে দখল-দূষণ-বালু উত্তোলন বহাল রাখার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেন। যখন যে দল দেশ পরিচালনা করে, সেই দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এ কাজে অভিন্ন ভূমিকায় থাকেন। তবে এক থেকে দেড় দশক ধরে নদী দখল সীমাহীন পর্যায়ে চলে গেছে। এসব দখলদার ও দখলদারের দোসরের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারলে নদী সুরক্ষা অসম্ভব। এসব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মনজুর আহমেদ চৌধুরী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্বই পালন করছিলেন এবং তা যথাযথভাবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনগতভাবে একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান। ১৩টি বিষয়ে কেবল পরামর্শ ও সুপারিশ করার ক্ষমতাটুকু দেওয়া আছে। উচ্চ আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর অভিভাবক ঘোষণা করেছেন, কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। এখনো আইন পরিবর্তন করে কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়নি। একটি দুর্বল কমিশনের চেয়ারম্যানের কার্যকর তেমন কিছুই করার নেই। এই কমিশন স্বাধীনও নয়, বরং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন। যদি কমিশনের চেয়ারম্যান কোনো ভুল কিংবা অন্যায় কাজ করে থাকেন, তাহলে মন্ত্রণালয় তাঁকে সতর্ক করতে পারত। সাধারণের অজ্ঞাতে কোনো অপরাধ করলেও পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার আগে তা জানানো প্রয়োজন ছিল।

মনজুর আহমেদ চৌধুরী অযোগ্য-অক্ষম নন, স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেননি, প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েননি। তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পত্র দেওয়া হয়েছে। পত্রটিকেজনস্বার্থেবলা হলেও চেয়ারম্যানের কোনো ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রশ্নহীন, অন্ধ অনুগত হলে তিনি স্বপদে বহাল থাকতেন। কিন্তু একটি সরকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের অন্ধ আনুগত্য দেশ বা রাষ্ট্রের কখনো কল্যাণ করে না; বরং যাঁরা গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাঁদের কথা শুনতে অপ্রিয় হলেও তা দেশ দলের জন্য কল্যাণকর।

মনজুর আহমেদ চৌধুরী এমন কোনো অপরাধ করেননি, যার কারণে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। সংগত কারণে নানাবিধ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে। তিনি অযোগ্য-অক্ষম নন, স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেননি, প্রতিষ্ঠান তথা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েননি। তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিলের পত্র দেওয়া হয়েছে। পত্রটিকে ‘জনস্বার্থে’ বলা হলেও চেয়ারম্যানের কোনো ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রশ্নহীন, অন্ধ ও অনুগত হলে তিনি স্বপদে বহাল থাকতেন। কিন্তু একটি সরকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের অন্ধ আনুগত্য দেশ বা রাষ্ট্রের কখনো কল্যাণ করে না; বরং যাঁরা গঠনমূলক সমালোচনা করেন, তাঁদের কথা শুনতে অপ্রিয় হলেও তা দেশ ও দলের জন্য কল্যাণকর।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন আতহারুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে আমাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তিনি নদীর পক্ষে থাকলেও নদী সুরক্ষায় সাহসী কোনো ভূমিকা নেননি। এরপর কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিবুর রহমান হাওলাদার। তিনি নদী সুরক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর সময়ে নদী রক্ষা কমিশন সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। আমরা যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করি, তখন কমিশনের সার্বক্ষণিক সহায়তা পেয়েছি। তিনি ছিলেন অকুতোভয়। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দায়িত্ব দেওয়া হয় এ এস এম আলী কবীরকে। তাঁর সময়ে কমিশন ঝিমিয়ে পড়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি এসে কমিশনকে আবার নদীর জন্য সক্রিয় করে তোলেন। তিনি শুরু থেকে ন্যায় ও সাহসী কথা বলেছেন। এ কারণে যদি কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সৎ ও সাহসী বিজ্ঞজনেরা এ পদে আসতে চাইবেন না।

 

মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সব কাজই যে ভালো হচ্ছিল তা নয়, তিনি বাংলাদেশের নদ-নদী: সংখ্যা সংজ্ঞা শীর্ষক বই প্রকাশ করেছেন। সেটি সীমাহীন ভুলত্রুটিতে ভরা। এ রকম বই প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। কমিশনের প্রকাশিত বই নিয়ে নদীকর্মীদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে অনেকেই এ বই নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। অনেকে বইটি দ্রুত সংশোধনের দাবি তুলেছেন। বইটি বাতিল না করলে
নদীর চরমতম ক্ষতি হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকলে তিনি হয়তো নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতেন। এখন বইটি সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হবে, এমন আশা কম।

নদী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনজুর আহমেদ চৌধুরী বিতর্কের জন্মও দিয়েছিলেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নদী দখলদারদের নাম প্রকাশ করা নিয়ে তাঁর কমিশনের অনীহা ছিল। দীর্ঘদিন যাঁরা নদী-পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সম্পর্কে অকারণে নেতিবাচক কথাও বলতেন। যাঁদের সহায়তার মাধ্যমে কমিশন আরও শক্তিশালী হতে পারত, তঁাদের দূরে ঠেলে দিয়ে অনেক কাজ কঠিন করে ফেলেছেন। নদীকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো থাকলে আরও অনেক কাজ করা সম্ভব হতো।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু ত্রুটি থাকলেও মনজুর আহমেদ চৌধুরী নদী সুরক্ষার কাজ করছিলেন। তাঁকে অপসারণ ভালো কিছুর ইঙ্গিত বহন করে না। এখন যিনি নতুন চেয়ারম্যান হয়ে আসবেন, তিনি কি তাঁর সাহসী পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারবেন?

https://www.prothomalo.com/opinion/column/nkwnl4iwa3