২৩ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৬:১১

রোহিঙ্গা সমস্যা এবং পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা 

-আশিকুল হামিদ

 

এই নিবন্ধ যেদিন প্রকাশিত হবে সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রাসেলসে অবস্থান করার কথা। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকার প্রধানদের সঙ্গে তার বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে। বলা হচ্ছে, এ ধরনের বৈঠক এবং সাত সমুদ্র ও নদনদী পাড়ি দিয়ে হলেও এ ধরনের বৈঠক এবং সে উপলক্ষে বিদেশ সফরের সুযোগ প্রধানমন্ত্রী সাধারণত ‘মিস’ করেন না। সে কারণে ধরে নেয়া যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ‘পশ্চিমাদের’ বিরুদ্ধে শোরগোল করা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে বৈঠকের জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাসময়ে ব্রাসেলসে গিয়ে হাজির হবেন। ইইউ নেতাদের মধ্যে কতজনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করতে পারবেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় থাকলেও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জনাকয়েক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি অন্তত সেলফি তোলার মতো ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করার ব্যবস্থা ঠিকই করে নেবেন। তার সে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য গত মাস সেপ্টেম্বরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। সেখানে অবস্থানকালে সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়া ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তিনি। এসবের মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি অনুষ্ঠান। সেখানেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেলফি তুলে এবং তার প্রচার করে প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়েছে, ‘সুযোগের অভাবে’ বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে বলতে না পারলেও প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত ও বৈঠক করেছেন। 

শুরুতে এতকথা বলার পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। কারণটি হলো, সরকার এবং আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রীর এই সফর নিয়ে এমনভাবে প্রচারণা চালিয়েছে যা দেখে মনে হতে পারে যেন তিনি অনেক বড় কিছু অর্জন করে এসেছেন। অথচ অন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মতো জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশ নেয়া এবং সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়ার বাইরে প্রধানমন্ত্রী এমন এমন কোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেননি, যার জন্য তার যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে এত বেশি প্রচারণা চালাতে হবে। বলা দরকার, কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও তিনি কোনো সাফল্যই অর্জন করতে পারেননি। একই কারণে তা সফরকে নিয়ে প্রচারণা চালানোর বিষয়টিও সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি। মানুষের মুখে বরং বাঁকা হাসি দেখা গেছে।

এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য ক্ষমতাসীনদের কিছুই যায়-আসে না। সে কারণেই জনগণের ভোগান্তি বাড়িয়ে হলেও দলটি তাদের নেত্রীকে সংবর্ধনা দেয়ার কর্মসূচি পালন করেছিল। অন্যদিকে সংবর্ধনা কেন্দ্রিক নিন্দা-সমালোচনায় প্রাধান্যে এসেছে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির হিসাব-নিকাশ। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দেয়ার জন্য হিসেবে ২০১৭ সালের অক্টোবরে মিয়ানমারের মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ের ঢাকা সফরের কথা তুলে ধরেছেন পর্যবেক্ষকরা। সেবার ২ অক্টোবর একদিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সরকারের পক্ষ থেকে তার সফরকে ‘বিরাট’ অর্জন হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা হালে পানি পায়নি। কারণ, নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা, তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ, রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া এবং মাস দেড়েকেরও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ থেকে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর মতো ভয়ংকর মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য কোনো রকম দুঃখ প্রকাশ করেননি অং সান সু চির পাঠানো মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে। অথচ কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্যের খাতিরে হলেও দুঃখ প্রকাশ করাটা মন্ত্রীর কর্তব্য ছিল। পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, মিস্টার সোয়েকে দিয়ে মিয়ানমার আসলে বুঝিয়ে দিয়েছিল, দেশটি যা করেছে সে সবের মধ্যে কোনো ভুল বা দোষ নেই। শুধু তা-ই নয়, জাতিগত নির্মূল অভিযানের অংশ হিসেবে গণহত্যা এবং ধর্ষণসহ দমন-নির্যাতন বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে বরং চলতেই থাকবে। এমন মন্তব্যের কারণ, সু চির এই মন্ত্রী কথায় তো বটেই, আকারে-ইঙ্গিতেও তেমন কোনো আশ্বাস দেননি, যার ভিত্তিতে ভালো কিছু আশা করা যাবে। শুভ কিছু আসলে হয়ওনি। 

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ‘যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্তটিও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, কথা ছিল, ওয়ার্কিং গ্রুপটি গঠন করবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এবং এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘খুব শিগগিরই’ মিয়ানমার সফরে যাবেন। অর্থাৎ আরো সময় পার হতে থাকবে এবং এই সময়ের মধ্যে প্রতিদিন আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসতে থাকবেÑ যেমনটি এসেছিল সে বছরের অর্থাৎ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে, যেমন এসেছিল ওই মন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক চলাকালেও। একথাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা ও নির্যাতনের অভিযানও চলতে থাকবে। কারণ, বাংলাদেশের দুই মন্ত্রীÑ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সু চির মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ে শুধু যথেষ্ট দাপটের সঙ্গেই ‘আলোচনা’ করেননি, নিজেদের ইচ্ছাও পুরোপুরি চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তার চাপের মুখে নতিস্বীকার করে বাংলাদেশকে এই প্রস্তাবও মেনে নিতে হয়েছিল যে, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিকে রাখা যাবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের কথা এসেছিল সুনির্দিষ্টভাবে। অর্থাৎ গ্রুপটিতে জাতিসংঘের কোনো সংস্থার কোনো প্রতিনিধিকে রাখা চলবে না। বিশ্বের দেশে দেশে রোহিঙ্গা সংকট যখন প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল এবং নিরাপত্তা পরিষদসহ সম্পূর্ণ জাতিসংঘই যখন বিষয়টিতে সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, তেমন এক জটিল সময়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধিকে রাখার ব্যাপারে মিয়ানমারের আপত্তি এবং সে প্রস্তাবে বাংলাদেশের সম্মতির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতারই প্রকাশ ঘটেছিল। 

প্রসঙ্গক্রমে সামনে এসেছিল সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত ও বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সে দেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর গণহত্যা প্রতিহত করাসহ সামগ্রিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকার চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই অভিযোগ উঠেছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সকল দেশ যখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা ও নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, এমনকি জাতিসংঘও যখন মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল, তেমন এক সম্ভাবনাময় সময়েও আওয়ামী লীগ সরকার কেবলই আশ্রয় ও তথাকথিত মানবিক সহায়তা দেয়ার মধ্যে সকল তৎপরতা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কূটনৈতিকভাবে তৎপর হয়নি। একটি উদাহরণ হিসেবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যেব এরদোগানের স্ত্রী এবং দেশটির ফার্স্ট লেডি এমিনো এরদোগানের কক্সবাজার সফরের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তুরস্কের ফার্স্ট লেডির সঙ্গে সরকারের কোনো মন্ত্রী ওই এলাকায় যাননি। অথচ এটা ছিল আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। মিসেস এরদোগানের প্রায় এক সপ্তাহ পর ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো কক্সবাজার সফরে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। বিষয়টির সঙ্গে ভারতের অনুমতি পাওয়া-না পাওয়ার সম্পর্ক জড়িত ছিল বলে অভিমত প্রকাশ করে পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত মোদি সরকারের ‘অনুমতি’র জন্য অপেক্ষা করেছিলেন! 

এসব কারণেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সংকটে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, এই সরকারের আসলে কোনো বন্ধু নেই। একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিত ভারত সংকটের শুরু থেকেই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর মাত্র কিছুদিন আগে দেশটি সফরকালে ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র নাথ মোদি খোলামেলাভাবেই গণহত্যার প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন। আরেক কথিত বন্ধুরাষ্ট্র গণচীনও প্রকাশ্যেই মিয়ানমারকে সমর্থন জানিয়ে চলছিল। একই অবস্থান নিয়েছিল রাশিয়াও। দেশ দুটির বাধা ও বিরোধিতার কারণে জাতিসংঘ পর্যন্ত পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। দেশ দুটি নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়ারও হুমকি দিয়েছিলÑ যার ফলে ২৮ সেপ্টেম্বরের (২০১৭) বিশেষ বৈঠকে কোনো প্রস্তাবই পাস করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের দহরম-মহরমের কোনো শেষ বা সীমা ছিল না। সীমা নাকি এখনও নেই! 

কথা শুধু এটুকুই নয়। সরকার একদিকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন পাওয়ার কোনো চেষ্টা চালানোর প্রমাণ দিতে পারেনি, অন্যদিকে তুরস্কসহ যেসব দেশ বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল বা আসতে চাচ্ছিল সেসব দেশের সঙ্গেও সরকার কূটনৈতিক রীতি-নীতি বিরোধী অসম্মানজনক আচরণ করেছে। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তুরস্কের ফার্স্ট লেডি মিসেস এরদোগানের সফরের সময়। মূলত এ ধরনের নীতি, মনোভাব ও কার্যক্রমের কারণেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে একেবারে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি ‘বিরল’ বিবৃতি কিন্তু সরকারের জন্য চমৎকার সুযোগের সৃষ্টি করেছিল। চীন ও রাশিয়ার কারণে প্রথম থেকে সংশয় থাকলেও ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে দেয়া এক সর্বসম্মত বিবৃতিতে নিরাপত্তা পরিষদ অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে চলমান গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধ করার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। ‘বিরল’ হিসেবে বর্ণিত ওই বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর ‘মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ’ করছে। এই সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, অসামরিক লোকজনের ওপর সশস্ত্র হামলা ‘একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’। রোহিঙ্গা মুসলিমরা ভয়াবহ মানবিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি তাদের সকলকে অবশ্যই নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার এবং আইনসম্মত নাগরিক হিসেবে মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে বসবাস করার সুযোগ দিতে হবে। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিতেও একই বক্তব্য রাখা হয়েছিল। 

প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় তথ্যটি জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা একটি ‘খোলা চিঠি’। গণহত্যা বন্ধ করে রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধান করার আহ্বান জানিয়ে প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ ১২ জন নোবেল বিজয়ী এবং ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরুর প্রাক্কালে প্রকাশিত এই ‘খোলা চিঠি’তে বিশ্বের ২৭ বিশিষ্টজন বলেছিলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবীয় ট্র্যাজেডি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ যে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে তার অবসানে জাতিসংঘের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদের এই মুহূর্তের দৃঢ় সংকল্প ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর মানব ইতিহাসের ভবিষ্যৎ গতিপথ অনেকটাই নির্ভর করছে বলেও নোবেল বিজয়ীসহ বিশিষ্টজনেরা মত প্রকাশ করেছিলেন।  

বলাবাহুল্য, নিরাপত্তা পরিষদের ‘বিরল’ বিবৃতি এবং ১২ জন নোবেল বিজয়ীসহ ২৭ বিশিষ্টজনের ‘খোলা চিঠি’র কারণে সৃষ্ট চমৎকার সুযোগের সদ্ব্যবহার করার ব্যাপারেও লজ্জাকর ব্যর্থতা ও চরম অযোগ্যতা দেখিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অথচ সদিচ্ছা থাকলে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে অবস্থান নেয়ার ও ভূমিকা পালনের অধিকার থাকলে ওই বিবৃতি ও খোলা চিঠির ভিত্তিতেই সরকার রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতো। অন্যদিকে সেটা সম্ভব হয়নি সরকারের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা এবং বিশেষ দুর্বলতার কারণে। বলা হয়েছিল এবং এ কথার সত্যতাও বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের নামে আয়োজিত এমন এক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতার দখল নিয়েছিল, যার কোনো পর্যায়েই জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। সেবার জনগণকে ভোটই দিতে দেয়া হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একদিকে ১৫৪ জন ‘নির্বাচিত’ এমপি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে শুধু একটি সংসদ ও সরকারই গঠন করা হয়নি, ওই সংসদকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী দলগুলোর ওপর ফ্যাসিস্ট কায়দায় দমন-নির্যাতনও চালিয়েছে। স্মরণ করা দরকার, একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশই ৫ জানুয়ারির ওই কর্মকান্ডের প্রতি সমর্থন জানায়নি বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ সকল রাষ্ট্র সংসদ ও সরকার গঠনের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করেছিল। 

এমন অবস্থার কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এর পাশাপাশি অন্য একটি বিশেষ কারণকেও সামনে আনা হয়েছে। মিয়ানমারের যে জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা ও নির্মূলের ভয়ংকর অভিযান চালানো হচ্ছে তারা মুসলিম। দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ‘সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গি’ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়েছে। এখনও চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টিকেই তার সমর্থন দেয়ার কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন। চীনের মতো কিছু রাষ্ট্রও এমন এক অসত্য প্রচারণা চালিয়েছে যে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা নাকি পাকিস্তানের আইএস-এর সঙ্গে জড়িত এবং তারা নাকি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে! বাংলাদেশ সরকারও নাকি তথাকথিত ইসলামী জঙ্গি বিরোধী একই নীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ফলপ্রসূ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না!

বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তরালে যা কিছুই ঘটে থাকুক বা ঘটতে থাকুক না কেন, ঘটনাপ্রবাহে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। এই ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ বাস্তবে বন্ধুহীন অবস্থায় পড়েছে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই মিয়ানমার হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠিয়েছে, দেশটির সামরিক হেলিকপ্টার যখন-তখন বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করারও দুঃসাহস দেখিয়েছ। 

সর্বশেষ ঘটনায় মন্ত্রী খিও টিন্ট সোয়ের সফরকালেও সরকার নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। মিয়ানমারের মন্ত্রী কিন্তু সকল রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেননি। তিনি বরং বলেছিলেন, ‘যাচাই ও প্রমাণ সাপেক্ষে’ সেই সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, যারা রাখাইন প্রদেশের ‘প্রকৃত’ নাগরিক। উল্লেখ্য, ১৯৮০-র দশকে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ রোহিঙ্গাদের ‘অবার্মিজ’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। সেই থেকে পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর। নির্যাতনের মুখে যারা পালিয়ে এসেছিল তাদের কারো পক্ষেই পরিচয়পত্র ধরনের কোনো কিছু আনা সম্ভব হয়নি, যা দিয়ে প্রমাণ করা যাবে যে, তারা রাখাইন প্রদেশের ‘প্রকৃত’ নাগরিক। অর্থাৎ কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যাবে। তাদের আর কখনো ফেরত পাঠানো যাবে না। 

এমন অবস্থায় ‘যাচাই ও প্রমাণ সাপেক্ষে’ রাখাইন প্রদেশের ‘প্রকৃত’ নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাসের মধ্যে সংকটের স্থায়ী সমাধানের কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বিষয়টিকে বরং মিয়ানমারের নতুন প্রতারণাপূর্ণ কৌশল হিসেবেই দেখা হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এসবই সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার কারণে সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন কারণেই পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বাস্তবে বাংলাদেশকে বিদেশে ‘ডুবিয়ে’ ছেড়েছে!

https://www.dailysangram.info/post/538770