১১ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ৩:২৫

চিকিৎসকের নেতৃত্বে প্লাটিলেট কিট পাচার

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে রক্তের জলীয় উপাদান পৃথক্করণে ব্যবহৃত ‘অ্যাফেরেসিস প্লাটিলেট কিট’ ও ‘এসিডিএ ফ্লুইড প্যাক’ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। সরকারি অর্থায়নে কেনা এসব চিকিৎসা সরঞ্জাম হাসপাতালের দুজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় পাচার হয়। সম্প্রতি কিটসহ সরঞ্জাম পাচারে জড়িত একজন হাতেনাতে ধরা পড়লে বিষয়টি সামনে আসে। এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনেও ঘটনার সত্যতা উঠে এসেছে। প্রতিবেদনসহ পাচারকৃত মালামালের তথ্য-উপাত্ত যুগান্তরের হাতে এসেছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ধরা পড়া কিট ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্য ১০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এই অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ঘটনায় হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের প্রধানসহ অন্য অভিযুক্তরা এখনো বহাল আছেন।
জানা যায়, ২০ আগস্ট হৃদরোগ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে ৭২ পিস ‘অ্যাফেরেসিস প্লাটিলেট কিট’ পাচার হয়, যার বাজারমূল্য ৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর এক সপ্তাহ পর ২৭ আগস্ট ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ৮০ পিস এসিডিএ ফ্লুইড (রক্ত জমাট প্রতিরোধী উপাদন) প্যাক পাচারকালে ঘটনাটি হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দীনের নজরে আসে। এ সময় বেসরকারি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডায়ামেডের বাপ্পী নামে একজন কর্মকর্তা হাতেনাতে ধরা পড়েন। পরিচালক তখন জানাতে চান কীভাবে কিট পাচার হচ্ছে। ওয়ার্ড মাস্টার বিল্লালকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেন। পরে ওই কর্মচারী ঘটনার তথ্য জানান।
ওয়ার্ড মাস্টার পরিচালককে বলেন, হাসপাতাল থেকে বাইরে নেওয়া মালামাল নিরাপত্তাকর্মীরা যেন গেটে আটকাতে না পারে, সেজন্য বক্সের মোড়কে ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. শাহরিয়ার কাউসারের সিল ও স্বাক্ষর ছিল। ওই চিকিৎসকের নাম ও স্বাক্ষর সংবলিত গেট পাশের তথ্যে লেখা ছিল-‘ডায়ামেড কোম্পানিকে ৯ বক্স কিট লোন দেওয়া হলো।’

হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম বেসরকারি কোম্পানিকে লোন দেওয়ার নিয়ম নেই। কোনো সরকারি হাসপাতালকে ধার দিতে হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন। তাছাড়া হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের এসব যন্ত্রপাতি সেখানে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার জন্যই নির্ধারিত। নিয়মবহির্ভূতভাবে বেসরকারি কোম্পানিকে ধার দেওয়ারও সুযোগ নেই। এর আগেও হাসপাতাল থেকে উচ্চমূল্যের সরকারি সরঞ্জাম পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

হৃদরোগ হাসপাতালের একজন অধ্যাপক যুগান্তরকে বলেন, দেশজুড়ে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের কারণে ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীদের মধ্যে প্লাটিলেটের ব্যবহার বাড়ছে। ব্লাড ব্যাংকগুলোয় প্লাটিলেট অ্যাফেরেসিস কিট ও এসিডিএ ফ্লুইডের চাহিদা বেড়েছে। একটি অ্যাফেরেসিস কিটের আমদানি মূল্য ১৩ থেকে ১৮ হাজার টাকা। সরকারিভাবে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহ করতে খরচ হয় আড়াই হাজার টাকা।

জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত ২০৬টি ব্লাড ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১৬টিতে প্লাজমা অ্যাফেরেসিস মেশিন আছে। ফলে বাধ্য হয়ে ডেঙ্গু রোগীর স্বজনরা প্লাটিলেট সংগ্রহে বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে এক ব্যাগ প্লাটিলেট সংগ্রহে ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের মতো বিশেষায়িত হাসপতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে অ্যাফেরেসিস সরঞ্জাম পাচারের পেছনে সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, ‘অ্যাফেরেসিস প্লাটিলেট কিট’ ও ‘এসিডিএ ফ্লুইড প্যাক’ পাচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রথমে জানান, এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। পরে তদন্ত কমিটির কাছে বলছে সরঞ্জামগুলো ত্রুটিযুক্ত ছিল, যা সম্পূর্ণ অসত্য। ত্রুটিযুক্ত সরঞ্জাম বাইরে গেলে সেখানে ‘লোন স্লিপ’ লেখা হলো কেন-প্রশ্ন তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তার। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালের সরঞ্জাম কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে লোন দেওয়ার এখতিয়ার নেই।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, হাসপাতালের রক্তপরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে পাচার হওয়া সরঞ্জামের মূল হোতা হিসাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের মেডিকেল অফিসার ও বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. হুমায়রা আলীমের নাম এসেছে। তার সহযোগী হিসাবে কাজ করেন একই বিভাগের ল্যাব ইনচার্জ (মেডিকেল টেকনোলজিস্ট) লায়লা খন্দকার। পাচারের সঙ্গে তাদের দুজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। অভিযোগের বিষয়ে তারা দুজনই তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিয়েছেন। বিভাগীর প্রধান তার মতো করে লিখিত ও মৌখিকভাবে ব্যাখ্যা দেন। অপরজন বলেছেন, আমি নির্দেশিত এ কাজ করেছি।

যা আছে তদন্ত প্রতিবেদনে : এ ঘটনায় কার্ডিওলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আলমকে সভাপতি, মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মেসবাহ উদ্দীন আহমেদকে সদস্য এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাফর উল্ল্যাহকে সদস্য সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ডা. শাহরিয়ার জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশে গেট পাশে সই করেছেন। লায়লা খন্দকার বলেছেন, আমি ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধানের (ডা. হুমায়রা আলীম) নির্দেশে মালামাল বের করে দিয়েছি।
সরঞ্জাম পাচারের বিষয়ে ডা. হুমায়রা আলীম তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত জবাবে বলেন, ‘লোনের বিষয়টি আমি অবগত। ইতঃপূর্বেও বিভিন্ন কোম্পানিকে এভাবে লোন দিয়েছি এবং ফেরত এনেছি।’ তিনি তদন্ত কমিটিকে মৌখিক জবাবে বলেন, ‘এই কিট ও এসিডিএগুলো কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরবরাহ করা। সম্প্রতি কিছু কিট ত্রুটিপূর্ণ এবং ক্র্যাশ করলে পরিবর্তনের জন্য পাঠাই।’ তদন্ত কমিটি জানতে চান, এসিডিএ প্যাকে কোনো সমস্যা ছিল না, তারপরও কেন দিয়েছিলেন-এমন প্রশ্নে ডা. হুমায়রা চুপ থাকেন।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ : কমিটি লিখিতভাবে বলছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ডা. হুমায়রা এ ধরনের নির্দেশ দিতে পারেন না। এসব সরকারি মালামাল কোনো প্রয়োজনে বাইরে নিতে গেলে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া উচিত। তাই ডা. হুমায়রা আলীমকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালনা বিভাগে স্থানীয় নিরীক্ষার পরামর্শ দেয় কমিটি।

এসব বিষয়ে হাসপাতাল পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, কিটের ঘটনা আরও তদন্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ইন্টারনাল অডিটের নির্দেশ দিয়েছি। কোনো মালামালের হেরফের পেলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/727432