১০ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:১১

... যাদের করেছ অপমান, অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান

ড. মো. নূরুল আমিন

একটি জাতীয় দৈনিক, আরো সুনিদিষ্টভাবে দৈনিক ইনকিলাব গত ৪ অক্টোবর বুধবার পাঁচ কলামের ব্যানার হেডিং-এ একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে। সোমবার রাতে ল-নের মেথডিষ্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্ট মিনিষ্টারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় দেয়া তার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত এই সংবাদের শিরোনাম ছিল, “রোজই শুনি মরে মরে ” ইনসেটে বলা ছিল,” * বয়স ৮০ বছর, সময় হয়ে গেছে, এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই, * প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেদিন সুযোগ পাবো ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দেব। * স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, বেশি-স্যাংশন দিলে আমরাও দিয়ে দেব।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘকাল ধরে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। তার লিভার ও কিডনি ধ্বংসপ্রায় এবং অবিলম্বে প্রতিস্থাপন না করলে তাকে বাঁচানো যাবে না বলে তার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এবং তাকে দিবেশে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তার পরিবারের সদস্যরা তার চিকিৎসার জন্য বিদেশে কয়েকটি বিশেষজ্ঞ হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে তাকে নেয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন।

উল্লেখ্য যে, বেগম জিয়াকে এই সরকার সম্পূর্ণ প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জিয়া দাতব্য ট্রাষ্ট্রের পরিচালনাধীন একটি ইয়াতিমখানার বানোয়াট অর্থ আত্মসাতের মামলায় আদালতকে প্রভাবান্বিত করে প্রথমে পাঁচ বছর ও পরে তা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি দ-প্রাপ্ত আসামী। বলাবাহল্য, অর্থ আত্মসাতের যে মামলায় তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে তাতে আত্মসাতের কোন ঘটনাই ছিল না। ইয়াতিমখানার সেই কথিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যাংক একাউন্টে বহাল তবিয়তে মওজুদ রয়েছে। শুধু তাই নয় সুদে আসলে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে তার পরিমাণ আট কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে অভিজ্ঞমহল জানিয়েছে। কিন্তু তথাপি ফরমায়েশী রায়ে বেগম জিয়াকে কারাভোগ করতে হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ নেয়ার জন্য পরিবারের আবেদন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন করার কথা ছিল। তিনি তা অনুমোদন না করে যা বলেছেন ইনকিলাবের ব্যানার হেডিং ছাড়াও দেশ বিদেশের পত্রপত্রিকাগুলোতে তাই প্রকাশিত হয়েছে। তার সরকারের আমলে বাংলাদেশে ভোটাধিকারসহ মানবাধিকার ও দুর্নীতি-অর্থপাচার প্রভৃতি কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কর্তৃক ভিসা স্যাংশন দেয়ার ঘটনার প্রতি ইংগিত করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্যাংশন দেয়ার কথাটিও বলেছেন। প্রকাশিত রিপোর্টে বর্ণিত কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কিনা তা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল, কেন না এগুলো ছিল অত্যন্ত কুরুটিপূর্ণ আত্মম্ভরিতা ও প্রতিহিংসার পরিচায়ক। অক্টোবর ৯ তারিখে আমি নিবন্ধটি লিখতে বসেছি। বক্তব্যটি প্রধানমন্ত্রীর না হলে পত্রিকায় প্রতিবাদ আসতো, তা আসেনি। কাজেই ধরে নেয়া যায় যে রিপোর্টে তার বক্তব্যের যথাযথ প্রতিফলনই হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে ফেরার পর গত শুক্রবার বঙ্গভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অবাধ-নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের পুনরুজ্জীবন ও তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “আমাকে বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে বসে থাকবো। ভোটে আসলে আবার করবো। দেখি কে দায়িত্ব নিতে রাজি হয়, সব রেডি করে দিয়েছি এখন আমাকে নির্বাচন শেখায় ইত্যাদি ইত্যাদি।

কথাগুলো এতই রূঢ় ও বাচ্চাসুলভ যে, একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিশেষ করে রাষ্ট্রনায়কের মুখনিঃসৃত হতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। কিন্তু প্রায় সপ্তাহ অতিক্রম করার পরও যখন এর কোন প্রতিবাদ বা সংশোধনী নজরে পড়লো না তখন ধরেই নিতে হলো যে, এগুলো নিখাত সত্য বচন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখনিঃসৃত।

মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তারা আল্লাহর খলিফাও। নৈতিক মূল্যবোধ, ভাল-মন্দ বুঝার ক্ষমতা, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলের প্রতি ইনসাফ কায়েম, হক্কুল্লাহ ও হক্কুল এবাদের অনুভূতি তাদের অন্যান্য ইতরপ্রাণী থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। এ প্রেক্ষিতে মানুষের পক্ষে যা ইচ্ছা তা বলা বা করার অধিকার নেই। মানুষের ক্ষমতাও চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণিকের। এজন্য তাকে অক্ষম ও দুর্বল একটি প্রাণী হিসেবেও গণ্য করা হয়। অক্ষম ও দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও তারা যখন ধরাকে সরা জ্ঞান করেন তখন বিপত্তি বাধে এবং ক্ষমতা যখন তাদের ছেড়ে যায় তখন তাদের অসহায়ত্ব দেখে দুনিয়া হাসে।

ফার্সি কবি শেখ সা’দীর কথা এই প্রজন্মের অনেকেই জানেন না। ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য এখন পড়ানো হয় না। তিনি ইরানের সিরাজ অঞ্চলে ১২১৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১২৯১ সালে তার মৃত্যু হয়। তিনি প্রথিতযশা একজন কবি এবং আলেম ছিলেন। ফারসী ও ইসলামী সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। গুলিস্তাঁ এবং বোস্তাঁ তার লেখা গদ্য ও পদ্য সাহিত্যের এক অনবদ্য কীর্তি। বহুদিন আগে বোস্তাঁ পুস্তকে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি হচ্ছে একটি গাধা ও মাছির গল্প। একদিন একজন কৃষক একটি কাঁঠাল গাছের সাথে তার গাধাটিকে বেঁধে রেখেছিলেন। গাধাটি পেশাব করলো এবং গাছের নীচে একটি গর্তে এসে তা জমা হলো। ঐ জমা পেশাবের উপর কাঁঠাল গাছের একটি পাকা পাতা এসে পড়লো। পাতাটি বাতাসে ভাসছিল। একটি মাছি এসে তার উপর বসে গান শুরু করেছিল। তার গানটি ছিল, ‘মাইনে এক বড়া জাহাজকা কাপ্তান হো গিয়া।’ আমাদের অনেক নেতানেত্রী ও সমাজপতিদের অবস্থাও এখন এই মাছিটির মতো; তারা একটি বড় জাহাজের কাপ্তান। ইংরেজ দার্শনিক বার্টা- রাসেলও মানুষকে নৈতিক জীব হিসেবে ¯্রষ্টার সৃষ্টি বলে গণ্য করে তাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি প্রাণী বলে অভিহিত করেছেন। তার সংজ্ঞা অনুযায়ী মানুষ হচ্ছে, ''A Puny specie on tiny planet revolving round a tenth rate star drifting aimlessly in a cosmic ocean.” অর্থাৎ জাগতিক সমুদ্রে দ্রুত গতিসম্পন্ন নক্ষত্রের চারদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘূর্ণায়মান ক্ষুদ্র গ্রহে মানুষ হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র ও দুর্বল একটি প্রাণী। এই প্রাণীর প্রাণ যে কোনও সময় চলে যেতে পারে। তখন তার ক্ষমতা আর দর্প কোনটাই থাকে না। মানুষকে সম্মান করা, তার যথাযথ মর্যাদা দেয়া মানুষেরই কাজ। আপনি ততটুকু সম্মান মানুষের কাছ থেকে আসা করতে পারেন যতটুকু সম্মান মানুষকে দেবেন। এই সত্যটি অনেকেই ভুলে যান।

খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও পাকিস্তান আমলের একজন মন্ত্রী মরহুম হাবিবুল্লাহ বাহারের নানা ফেনী কোর্টের একজন মোক্তার ছিলেন। এই পদটি এখন নেই, সবাই এডভোকেট হয়ে গেছেন। কথিত আছে কোর্টে আসা যাওয়াকালে তিনি স্কুলের ছেলেদের সালাম করতেন, তাদের সালাম দেয়ার সুযোগ দিতেন না। তার বন্ধুবান্ধবরা এতে আপত্তি করলে তিনি বলতেন এই ছাত্র কিশোররা একদিন লেখাপড়া শিখে হাকিম হবে, আদালতে বসবে। আর মোক্তার হিসাবে আমি আসামীর জামিন দেয়ার জন্য তাদের মুখাপেক্ষী হবো। তাই আগেভাগে তাদের সাথে খাতির করে নিচ্ছি। কথাটার মধ্যে যেমন কৌতুক রস ছিল তেমনি তাৎপর্যও ছিল। এর মাধ্যমে তিনি ছেলেদের যেমন আদব কায়দা শেখাতেন, তেমনি ছেলেরাও তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। শিষ্টাচার শেখানোর এটি একটি পদ্ধতি। আমাদের সরকারি প্রশাসনের সাথে যারা জড়িত তারা কি এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারেন না।

এখন অন্য প্রসঙ্গে আসি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং ২০১৮ সালে সন্ত্রাস, কারচুপি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে রাতের ভোটে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রভাবশালী অনেক নেতানেত্রী ও মন্ত্রী-উপমন্ত্রী এখন নতুন একটি শ্লোগান দিতে শুরু করেছেন। শ্লোগানটি হচ্ছে ‘গণতন্ত্র নয় উন্নয়নই জাতীয় সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।’ স্লোগানটি আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা গ্রামেগঞ্জে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে বলে জানা গেছে। তারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা অন্নবস্ত্রের-যোগাযোগের, গণতন্ত্রের নয়। কিন্তু কথাগুলো শুনতে ভাল লাগলেও তাদের এই প্রচারণা মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলছে বলে অভিজ্ঞমহল জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত ১৪ বছরের শাসনামলে তারা দেখেছেন যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকেই শুধু পদদলিত করেনি বরং জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি খাতকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে ছেড়েছে। তারা গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দু’টোই ধ্বংস করেছেন। গণপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সর্বত্র এখন অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ দলীয় নেতা ও দলদাসদের অবাধ বিচরণ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে চলছে সীমাহীন লুটপাট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনসমূহ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি ও ব্যভিচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। একজন কবি ও আর্টিস্টের ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এক দরজা দিয়ে শিক্ষা লাভের জন্য মানুষের বাচ্চা ঢুকছে অন্য দরজা দিয়ে তারা পশুর বাচ্চা হয়ে বেরিয়ে আসছে। এগুলোর নাম কি উন্নয়ন? আওয়ামী লীগ কি এই উন্নয়নকেই গণতন্ত্রের ওপর প্রাধান্য দেয়ার জন্য মানুষকে মোটিভেট করার চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে আমি একবার নোয়াখালী গিয়েছিলাম। শহরে ড্রেনেজের কোনও ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। মাইজদী শহরের প্রধান সড়কের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই জলাবদ্ধতা। রাস্তাঘাট নেই, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এতিমখানা দেখার শখ ছিল: কিন্তু পারিনি। ভেতরে গাড়ি নেয়া যায় না আবার পায়ে হেঁটে কাদা মাড়িয়ে যেতেও পারিনি। মাইজদী বাজারে ঢুকেছিলাম, বেশি দূর যাওয়া যায়নি। সারা বাজারে কাদা। বলাবাহুল্য, মাইজদী বাজারের কয়েকশ’ গজ দূরেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আবার পৌর সভার দফতরও বেশি দূরে নয়। সরকারের প্রশাসন ও উন্নয়ন এজেন্সি ছাড়াও এমপি সাবরা আছেন। তাদের কাজ কি আমি বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে লাকসাম হয়ে ঢাকা এসেছি। রাস্তার দু’ধারে বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ি, লাঙ্গলকোট, নাথেরপেটুয়া, মনোহরগঞ্জের অবস্থা যা দেখলাম গত ৫০ বছরে তা দেখিনি। যে জমিতে এই মওসুমে রবিশস্য চাষের প্রস্তুতি চলতো এবং চাষ হতো সে সব জমি এখন পানির নিচে। অনেক বাড়ির উঠানেও পানি। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে লোকজন এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করে। জমি থেকে পানি নামছে না; স্থবির হয়ে আছে। লোকজনকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলাম, তারা জানালেন এলাকার খালগুলো সব দখল হয়ে গেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভরাট করে ভোগ দখল করছেন। পানি নিষ্কাশনের কোনও রাস্তা নেই। এই অবস্থা আমি সারা অঞ্চলে দেখেছি। মানুষ যে কি কষ্টে আছে তার খোঁজ নেয়ার কেউ আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, হামলা, মামলা প্রভৃতির মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঘর ও এলাকা ছাড়া করেছে। নিজেরা দ-েমু-ের কর্তা সেজে বসেছেন। তারা এখন সম্রাট। এলাকার খোঁজখবর নেবে কে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট পাবার তাগিদ থাকে, মানুষকে জবাবদিহি করতে হয়। বিনা ভোটে নির্বাচিত হবার সুযোগ থাকলে অথবা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গৌণ হয়ে পড়লে এই জবাবদিহিতার আর কি কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে? শাসক দল মানুষকে এখন আর মানুষ বলে মনে করেন বলে মনে হয় না। রাজধানীর উড়াল সড়ক ও মহাসড়ক ভিত্তিক ফ্লাইওভারের ন্যায় হাজার-লক্ষ কোটি টাকার মেগা প্রজেক্টের পারসেন্টেজ ও নামে-বেনামে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ খেয়ে তারাই মোটা হচ্ছেন, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে না। আর এটা উন্নয়নও নয়। ফ্লাইওভারের নির্মাণ পর্বে গার্ডার ভেঙে যারা মরছেন তারাও সাধারণ মানুষ, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী নন। কাজেই সাধারণ মানুষের দুঃখ তারা বুঝবেন কেমন করে? সাড়ে চৌদ্দ বছরে ১৭ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের জবাব দেবে কে?

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার চর্চা, মৌলিক মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা প্রভৃতি মানুষের জন্মগত অধিকার এবং এগুলোর অনুশীলন পশু ও মানুষের ব্যবধান নির্ণয় করে। একটা কুকুরকে খাবার দিলে সে ঘুমায়, কিন্তু মানুষ তা করে না। সে অপরাপর দায়িত্বও পালন করে। করতে চায়। মানুষ নৈতিক জীব, পশু নৈতিক জীব নয়। মানুষ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, আচার-ব্যভিচার, সুকৃতি-দুষ্কৃতি বুঝে, পশু বুঝে না। কাজেই কেউ যদি তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে চায়, তাদের সাথে প্রতারণা করে তারা তা বুঝতে পারে এবং আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত করে। এ জন্য ডিক্টেটর অথবা তথাকথিত বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটররাও দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারেননি। শ্রীলংকা এর নগদ প্রমাণ। জুলুম-শোষণ মানবিক মূল্যবোধের সাথে খাপ খায় না। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের আমলে এদেশে উন্নয়ন কম হয়নি। তখন আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মৌলিক মানবাধিকার ও বাক এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। তখন যদি উন্নয়ন গণতন্ত্রের তুলনায় বেশি মূল্যবান না হয়ে থাকে তাহলে এখন হবে কেন? আর যারা এখন এসব কথা বলেন, তারা প্রতারক হিসেবে শাস্তি পাবেন না কেন?

ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোস এর নাম শুনেননি রাজনীতি সচেতন এমন লোক গত শতকে খুবই কম পাওয়া যেতো। তিনি নামকরা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে দেশ শাসন করেছেন। আমি ১৯৯৬, ১৯৯৭ সালে এবং ২০০১ সালে তিনবার ফিলিপাইন সফর করেছি। প্রথমবার লস ব্যানসের ইউপিএলবিতে ৬ মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সৌজন্যে তখন এবং পরবর্তী দু’বারের সফরে ফিলিপাইনের বেশিরভাগ এলাকা ও প্রতিষ্ঠান দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। মার্কোসের আমলে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ব্যাপক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তা ছিল অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। কিন্তু তার সরকার ছিল একনায়কসুলভ কর্তৃত্ববাদী প্রকৃতির; বিরোধিতা বা ভিন্নমত তিনি সহ্য করতেন না। উন্নয়ন তিনি করেছেন ঠিকই কিন্তু দেশটিকে সাথে সাথে তিনি দুর্নীতি-ব্যভিচারের আস্তাকুঁড়েও পরিণত করেছিলেন, যা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা একুইনো জুনিয়ারকে হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালের গণবিস্ফোরণ তাকে টিকে থাকতে দেয়নি।

তিনি ১৯৪৯-১৯৫৯ পর্যন্ত প্রতিনিধি সভার সদস্য, ১৯৫৯ থেকে ‘৬৫ সাল পর্যন্ত সিনেটের সদস্য হিসেবে দেশের অনেক সেবা করেছিলেন। কিন্তু গণবিস্ফোরণ তার এই সেবার কোনো মূল্যায়নই করেনি। কেননা তিনি মানুষের উপর জুলুম করেছিলেন এবং তার, তার পরিবারের ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক শাসন বহাল রাখেন। ১৯৮৬ সালের গণবিস্ফোরণে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তাকে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মার্কিন আদালতে মামলা হয়। আদালত যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা তার অর্থের দুই বিলিয়ন ডলার ফিলিপাইন সরকারকে ফেরত প্রদানের আদেশ দেন। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে হনু লুলুতে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার লাশ এখনো ইলোকস নটে Refrigerated crypt-এ রাখা আছে। কেননা ফিলিপাইন সরকার এখনো পর্যন্ত দেশে এনে তার লাশ দাফনের অনুমতি দেয়নি যদিও তার ছেলে এখন ক্ষমতায়। দুনিয়ার জালেম স্বৈরশাসকদের এই ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে আমি মনে করি। মানুষকে অপমান করে সম্মান পাওয়া যায় না। কবির ভাষায় তাই বলতে ইচ্ছে হয়, হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছ অপমান, অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান।

https://www.dailysangram.info/post/537587