৯ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৫:৩৩

মানুষের জীবন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা

আশিকুল হামিদ

হাই কোর্ট শুধু শাব্দিক অর্থেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত নয়, জনস্বার্থে ভূমিকা পালন ও অবদান রাখার দিক থেকেও এর অবস্থান সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিভিন্ন বেঞ্চের মাধ্যমে হাই কোর্ট সে ভূমিকা যেমন পালন করে চলেছে তেমনি রাখছে অবদানও।

এভাবে শুরু করার কারণ হলো, সাধারণভাবে অপরাধের বিচার করা প্রধান দায়িত্ব হলেও হাই কোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা ধর্ষণ ও গুপ্ত হত্যা থেকে পরিবেশ পর্যন্ত এমন কিছু বিষয়েও পর্যবেক্ষণ প্রকাশ এবং রায় দেয়ার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে চলেছেন, যেগুলো তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। যেমন সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কঠোর আদেশ দিয়ে জনগণের মধ্যে তারা আশাবাদের সৃষ্টি করেছেন। একইভাবে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে পরিবেশ সম্পর্কিত তাদের পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য এবং নির্দেশনা।

উদাহরণ দেয়ার জন্য এখানে রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধের জন্য মাননীয় বিচারপতিদের ঘোষিত নয় দফা নির্দেশনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দুটি পরিবেশবাদী সংগঠনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ সম্প্রতি নির্দেশনাগুলো জারি করেছেন। ঘোষিত এসব নির্দেশনায় মাত্রাতিরিক্ত কালো ধোঁয়া ছড়ানো সকল যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সড়ক পরিবহন আইনের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক যানবাহনের ইকনোমিক লাইফ নির্ধারণ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতিরা। এর পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া গাড়ির টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং করাও নিষিদ্ধ করেছেন তারা। ঢাকা, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে যেসব অবৈধ ইটের ভাটা এখনো বন্ধ করা হয়নি সেগুলোর ব্যাপারে ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার এবং বেঞ্চের কাছে রিপোর্ট পেশ করার জন্যও তারা সময় বেঁধে দিয়েছেন।
হাই কোর্ট বেঞ্চের নির্দেশনায় আরো বলা হয়েছে, ঢাকায় বালি, ময়লা ও বর্জ্য বহনকারী সকল ট্রাককে ঢেকে চলাচল করতে হবে। যেখানে নির্মাণ কাজ চালানো হবে সেখানে বালি, মাটি ও সিমেন্টসহ সকল নির্মাণ সামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে। সিটি করপোরেশনের ধূলোবালিপ্রবণ প্রতিটি এলাকায় পানি ছেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দোকান ও মার্কেট এলাকায় দিনের ময়লা-আবর্জনা ডাস্টবিন বা বস্তায় ভরে রেখে রাতের বেলায় ময়লা ফেলার জন্য নির্ধারিত স্থানে ফেলে আসতে হবে। দোকান ও মার্কেট বন্ধ করার সময় এগুলোর মালিকরা ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। নাহলে তারা দায়ী হবেন। রায় হিসেবে ঘোষিত নয় দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও অবস্থা সম্পর্কে হাই কোর্টকে অবহিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতর-অধিদফতরগুলোর প্রধানদেরও আদেশ দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতিরা। এক মাসের সময় বেঁধে দিয়েছেন তারা। নির্মল বায়ু ও পরিবেশের প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্বব্যাংক যে তিনশ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সে প্রকল্পের অগ্রগতি ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে হবে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে। তাকে বায়ুদূষণের কারণ এবং দূষণ রোধের জন্য নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কেও ব্যাখ্যাসহ জানাতে বলেছেন বেঞ্চ।

পর্যালোচনায় দেখা যাবে, মাননীয় বিচারপতিদের নয় দফা নির্দেশনা অত্যন্ত সময়োচিত এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক উপলক্ষে ঢাকাকে একটি প্রধান দূষিত নগরী হিসেবে চিহ্নিত করে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বায়ুদূষণের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। রিপোর্টটিতে আরো বলা ওই এক মাসের বেশ কয়েকদিন ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর। কোনো শহরের বায়ু দূষণের মাত্রা ৫০ পর্যন্ত হলেই শহরটিকে যেখানে অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানে ২৪ নভেম্বরসহ কয়েকটি দিন ঢাকার দূষণের মাত্রা ছিল ১৯৪! একাধিক গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, এসময়ের কোনো কোনোদিন দূষণের সূচক এমনকি ২০০-ও ছাড়িয়ে গিয়েছিল!

এ ধরনের একটি আশংকাজনক রিপোর্টের পর আশা ও ধারণা করা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার নিশ্চয়ই পরিবেশ স্বাভাবিক করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। ফলাফলও যা হওয়ার ঠিক তা-ই হয়েছে। রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা বরং অনেক বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দূষিত বাতাসের দিক থেকে ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান নগরীর অবস্থানে উঠে এসেছে। ডিসেম্বর মাসের কোনো কোনোদিন সকাল ১০টা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে ঢাকার স্কোর ২১০-এ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এর অর্থ হলো, রাজধানীর বাতাসের মান অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে।

বলা দরকার, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মাধ্যমে প্রতিদিন বিভিন্ন শহরের বাতাসের মান তৈরি করে বাতাস কতটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং দূষিত বাতাসের কারণে ওই শহরের মানুষেরা কি পরিমাণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেÑ এসব বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং সব দেশই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয় সব দেশ। ইনডেক্সের মান ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত হলে তার অশুভ প্রভাব পড়ে জনস্বাস্থ্যের ওপর। তেমন অবস্থায় বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষদের বাড়ির ভেতরে থাকার এবং বাইরে কোনো কাজকর্ম না করার পরামর্শ দেয়া হয়।

অন্যদিকে ইনডেক্সের স্কোর যদি ১০১ ছাড়িয়ে ১৫০ পর্যন্ত হয় তাহলেই তাকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপদজনক মনে করা হয়। সেদিক থেকে ২১০-এ উঠে যাওয়ায় রাজধানী ঢাকার বাতাসের মান যে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। ভীতি ও উদ্বেগের কারণ হলো, বর্ষাকালে কিছুটা উন্নতি ঘটলেও শীতের শুকনো মৌসুমে বায়ুদূষণের মাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে বলে সতর্ক করা হয়েছিল। তীব্র শীতের কারণে বিগত দুটি মৌসুমে দূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে বলেও ধরে নেয়া যায়। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দূষণ প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা তো নেয়া হয়-ইনি, উল্টো মেট্রোরেল ধরনের নির্মাণ কাজের মাধ্যমে পরিবেশকে আরো বিপদজনক করে তোলা হচ্ছে। এসবের ফলে দূষণের সূচকও ক্রমাগত ওপরে উঠে চলেছে। ভীতি ও উদ্বেগের অন্য এক প্রধান কারণ হলো, বায়ুদূষণের পরিণতিতে জটিল ও দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখই কেবল ছড়িয়ে পড়ছে না, দেশে মৃত্যুর হারও বেড়ে চলেছে। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। সে কারণে দুরারোগ্য নানা অসুখ-বিসুখ তো বাড়ছেই, মানুষের আয়ুও অনেক কমে যাচ্ছে।
দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, উন্নয়নের নামে চলমান নির্মাণ কাজের পাশাপাশি ইটের ভাটাগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ কালো ধোয়া ঢাকার বাতাসে মিশতে থাকে।

দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া। এ দুটির সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ছড়িয়ে পড়া ধূলোবালি। ফ্লাইওভার এবং বিশেষ করে মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণ উপলক্ষে বছরের পর বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলতে থাকায় ঢাকার বাতাসে ধূলোবালির পরিমাণও আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। ফলে রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ ফুসফুসের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, চোখের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং নিউমোনিয়ার মতো বিভিন্ন রোগবালাই বেড়ে চলেছে।
সব মিলিয়েই রাজধানী ঢাকার দূষিত বায়ু ও পরিবেশ যে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেকথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই একদিকে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তাদের দায়ের করা রিটের ওপর নয় দফা নির্দেশনা জারি করেছেন হাই কোর্ট বেঞ্চ। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য হাই কোর্ট বেঞ্চের নয় দফা নির্দেশনার আলোকে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া। মেট্রোরেল লাইনসহ চলমান সকল নির্মাণ কাজ দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে এবং কাজ চলাকালীন সময়ে পানি ছেটানোর মতো এমন কিছু ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক রাখতে হবে, যার ফলে বাতাসে ধূলোবালি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। দ্বিতীয় একটি পদক্ষেপ হিসেবে রাজধানীর ভেতরে ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে সকল ইটের ভাটা সরিয়ে দিতে হবে। হাই কোর্ট বেঞ্চের নির্দেশনার ভিত্তিতে বায়ুদূষণ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় অন্য সকল ব্যবস্থাও নিতে হবে কাল বিলম্ব না করে। পরিবেশবাদীদের মতো সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমরাও চাই, রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশ বায়ুদূষণের কবলমুক্ত হোক এবং নিরাপদ হোক মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবন।

https://www.dailysangram.info/post/537516