সুনামগঞ্জে গত রোববার রাতের কালবৈশাখীর তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে বহু বাড়িঘর। ছবিটি গতকাল সদর উপজেলার কালীপুর গ্রাম থেকে তোলা
৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৫৫

সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় কালবৈশাখী

ধান ও মাছের পর মাথা গোঁজার ঠাঁইও গেল

ইবার মন অয় আমরার কপালটাই খারাপ। একটার পর একটা বিপদ। খরচার হাওরে আড়াই একর জমি ছিল, সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এবার গেল ঘর। আর তো কোনো কিছু বাকি নাই। মনটা অখন একবারে ভাঙি গিছে। আর কত সইতাম।’ এই আক্ষেপ সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার হালুওয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক হোসেন মিয়ার (৪০)। এক বছর আগে নতুন একটি টিনের ঘর তুলেছিলেন তিনি। গত রোববার রাতের কালবৈশাখীতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত সেই ঘর। এখন প্রতিবেশীর উঠোনে ছাপরা ঘর তুলে থাকছে তাঁর পুরো পরিবার।

দুর্যোগ-দুর্ভোগ যেন পিছুই ছাড়ছে না সুনামগঞ্জের ফসলহারা মানুষের। অকালবন্যায় ডুবেছে হাওরের ধান, পানি দূষিত হয়ে মরেছে মাছ আর হাঁস। এবার কালবৈশাখীতে গেল তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই।
রোববার রাতে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখীর তাণ্ডবে সাড়ে ১১ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বসতবাড়ি হারিয়েছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। ঝড়ের সময় আহত হয়েছে অন্তত ৮৪ জন।
ঝড়ের পর থেকে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে পুরো জেলা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে আংশিক বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হলেও পুরো জেলায় তা স্বাভাবিক হতে আরও দু-তিন দিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার রাত সোয়া ১১টায় সুনামগঞ্জে প্রবল বেগে ঝড় শুরু হয়। প্রায় আধঘণ্টা স্থায়ী ওই ঝড়ে জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে নয়টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৮৮টি ঘরবাড়ি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮ হাজার ৫২১টি। ঝড়ের সময় আহত হয় ৮৪ জন। তাদের মধ্যে ১২ জন জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আছে। জেলার দুর্গত মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য নিয়ে যাওয়া ১৮ মেট্রিক টন (৩৬০ বস্তা) চালসহ একটি নৌকা ঝড়ের কবলে পড়ে সুরমা নদীতে ডুবে যায়। পৌর শহরের মল্লিকপুর এলাকার খাদ্যগুদামের ঘাটে এ ঘটনা ঘটে। পরে সোমবার দিনভর চেষ্টা করে নৌকা ও ভেজা চাল উদ্ধার করা হয়।
সদর উপজেলার হালুওয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক সুজন মিয়া বলেন, ‘সবই ত শ্যাষ। আগে ধান গেছিল, এখন ঘর গেছে। আর চিন্তা খররাম না, যা অইবার অইব।’

সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান জয়নুল জাকেরীন বলেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অলিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমার এলাকায় মনে হচ্ছে ক্ষতি বেশি হয়েছে। চারদিক থেকে মানুষ ক্ষয়ক্ষতির কথা জানাচ্ছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রথমে তাদের টিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সে জন্য উপজেলায় বরাদ্দ পাঠানো হবে।
সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘ছাতক-সুনামগঞ্জের ৩৩ কেভি লাইনের কয়েকটি খুঁটি ভেঙে পড়েছে। এসব স্থানে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। শহরের ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ। তবে শহরের কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ চালু করা হয়েছে। আমরা কাজ করছি। পুরো জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দুই-তিন দিন সময় লাগবে।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, হাওরে অকালবন্যায় এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলায় এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। তবে স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিধিরা বলছেন, জেলায় আবাদ হওয়া বোরো ধানের প্রায় ৯০ শতাংশই বন্যায় নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিন লাখ কৃষক পরিবার। হাওরের ফসল হারিয়ে কৃষকেরা এখন নিঃস্ব, দিশেহারা।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1166586