৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৪৯

চালের দাম বাড়ছেই

রাজধানীসহ সারা দেশে দফায় দফায় বাড়ছে চালের দাম। সম্প্রতি আবারো নতুন করে বেড়েছে দাম। এখন
বাজারে সব ধরনের চালের কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেশি দিতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাকে। এদিকে অকাল বন্যায় হাওরের বোরো ফসল নষ্ট হওয়ায় চালের দামে এমন অস্থিরতা চলছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ৪০ টাকার কমে মোটা চাল মিলছে না। সরু চালের ভোক্তাদের গুনতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। চালের এই নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারদের। পাইকারি বিক্রেতাদের অভিযোগ মজুতদার মিল মালিকদের দিকে। প্রায় এক বছর ধরে অস্থির চালের বাজার। দিন দিন এ অস্থিরতা বাড়ছেই। মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে গ্রাম পর্যায়ে ডিলারদের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রি করা হচ্ছে। শহরেও চালু আছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খোলা বাজারে ওএমএস কার্যক্রম। কিন্তু কোনো কিছুতেই কমছে না চালের দাম।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চালের দাম বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হলেও দেশের প্রান্তিক কৃষকের মুখে হাসি নেই। গোলায় ধান না থাকায় দাম বাড়ার কারণে সেই সুফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। ধান এখন মিলারদের গুদামে। মৌসুমের শেষ দিকে এসে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এখন বাজারে যেসব চাল বিক্রি হচ্ছে তার বেশির ভাগ হলো মজুতদার, মধ্যস্বত্বভোগী বড় বড় মিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর এপ্রিলের শেষে খুচরা বাজারে মোটা চালের কেজি ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। আর এবার এপ্রিলের শেষে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা বা ৩১.৮২ শতাংশ। এই চাল মূলত গরিব খেটে খাওয়া মানুষেরাই কিনে থাকেন। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন এসব মানুষ।
রাজধানীর কাওরান বাজার, হাতিরপুল, সেগুনবাগিচা ও মহাখালী কাঁচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪২-৪৩ টাকা। কিছুদিন আগেও যা কেজিতে দুই টাকা কম ছিল। মাঝারি মানের চালের দামও উঠেছে ৪৬-৪৮ টাকায়। সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা কেজি দরে। এ দুই ধরনের চালের দাম কেজিতে তিন টাকা বেড়েছে। এছাড়া পারিজা-স্বর্ণার মতো মোটা চালও বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। আটাশ ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। নাজিরশাইলের কেজি ৫৬ থেকে ৫৭ টাকা। মিনিকেট ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা। বাসমতি বিক্রি হচ্ছে ৫৯ থেকে ৬২ টাকা দরে। চালের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি সব মানুষকেই নাড়া দিয়েছে। এর কারণে প্রতিটি পরিবারেই মাসিক খরচ বেড়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।
কাওরান বাজারের দোকানগুলো গতকাল সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল। তবে কয়েকটি দোকান ছিল খোলা। বিক্রেতা আরিফুল ইসলাম বললেন, এক বস্তা মিনিকেট চালে এখন বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ৩০০ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) মতে, গরিব মানুষের চালের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। দিন দিন এসব মানুষ নিজের পরিবার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছেন। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া দরকার। যারা বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ায়, তাদের ব্যাপারে সরকার চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের এ সময়ে নতুন বোরো মৌসুমের চালের সরবরাহ শুরু হয়। তবে এ বছর শীত বিলম্বিত হওয়া এবং চলতি মাসে হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণে ধান উঠতে দেরি হচ্ছে। আবার হাওর এলাকায় ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে আগামী দিনে চালের সরবরাহ কিছু কম হওয়ায় এর প্রভাব বাজারে পড়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দাবি করেছেন হাওর ডুবে গেলেও চালের কোনো ঘাটতি হবে না। তার দাবি, বাংলাদেশে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। হাওরে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হলেও কোনো ঘাটতি হবে না।
এদিকে গত রোববার সচিবালয়ে রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত ও সরবরাহ পরিস্থিতি চাহিদার তুলনায় বেশি আছে। আগামী রমজানে তাই দাম বাড়ানো হবে না- ব্যবসায়ীদের এমন আশ্বাসে বিশ্বাস রেখেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। মন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬-২০০০ সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী থাকার সময়ও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় বাজার দর স্বাভাবিক রাখতে পেরেছিলাম। এবার মন্ত্রী হয়েও তা পেরেছি। বাজার নিয়ন্ত্রণে আসলে কড়াকড়ি নয়, ব্যবসায়ীদের বন্ধু হিসেবে ভাবতে হয়। তাদের প্রতি বিশ্বাস আছে।

সূত্র জানায়, চালের দাম বাড়লেও এর সুফল পায়নি ধান উৎপাদনকারী কৃষক। কারণ কৃষক পর্যায় থেকে ন্যায্যমূল্যের চেয়ে কম দামে ধান কিনে মজুত করা হয়েছে। এখন মজুতকৃত ধানের দাম বাড়িয়ে চালের বাজার থেকে অতি মুনাফা করছেন মিল মালিকরা। এছাড়া এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় দালাল ও ফড়িয়ারাও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। হওরের পরিস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এবার বোরো মওসুমে ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এ থেকে ১ কোটি ৯১ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় তা কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা আছে। হাওরের ২ লাখ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছিল। সেখান থেকে প্রায় ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের আশা করেছিল অধিদপ্তর। তবে সেখানকার বড় অংশের ধানই নষ্ট হয়ে যাবে আশঙ্কা তাদের।
উত্তরাঞ্চলে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা
সিদ্দিক আলম দয়াল, উত্তরাঞ্চল থেকে জানান, সরকারি চাকুরে ছাড়া চালের দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছে গাইবান্ধা সহ উত্তরজনপদের ৮ জেলার মধ্যবিত্ত, দিন মজুর ও ক্ষেটে খাওয়া মানুষ। যে হারে চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে দিন মজুরদের দুবেলা খাবার জুটলেও মহা বিপাকে ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের মানুষ।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার নিকুদ্দারী এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক জানান, মাত্র ৭ দিনের মধ্যে কয়েক দফা চালের দাম বেড়েছে। প্রতি কেজিতে অন্তত ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে চালের দাম হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। উপজেলা হলেও এখানকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে চালের দাম নিয়ে। কৃষকদের ঘরে ধান না ওঠা পর্যন্ত তাদের চাল কিনে খেতে হয়। তাই তারাও বিপাকে পড়েছেন চাল কিনতে গিয়ে। মৌসুমী ধান ও চাল বিক্রি করেছেন। ঘরে যা রেখেছিলেন তাও শেষ। এখন কিনে খাওয়ার দিন এসেছে বলে জানান কৃষক মোমতাজ আলী। দিনাজপুর জেলা ধান পাটসহ বিভিন্ন ফসলের বাম্পার ফলনের জেলা। এজেলার ধান চাল দিয়ে দেশ বিদেশেও রপ্তানি হয়। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন থেকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে দরিদ্র আদিবাসী কৃষক ও বর্গাচাষীরা পড়েছেন বিপাকে। দিনভর অন্যের জমিতে কাজ করেন কুটিয়া মার্ডি। তিনি ভর বছর কাজ করেন কৃষি মজুর হিসাবে। হাতে করে পেটে খাওয়ার ৭ জনের মুখে খাবার তুলে দেন। অন্যের জমিতে কামলা দিয়ে এক বেলা খেয়ে মজুরি জোটে ৩শ টাকা। দিনে তিন বেলা ৬ জনের সংসারে শুধু চাল লাগে ৫ কেজি ।
গাইবান্ধার চালের বাজারে এখন আগুন। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ১০ দিন আগে পাইজাম প্রতি কেজি বিক্রি হতো ৩৪ টাকায়। গত পরশু থেকে সেই চাল কেজি প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা । ওই পাইজাম বাজারে দেখা মিললেও বেচা হচ্ছে ৩৯ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে। শহরের পুরাতন বাজারে পাইকারি চালের আড়ৎদার আশরাফ আলী। তিনি জানান, নতুন ধান ও চাল বাজারে ওঠার আগে চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই। তারপরও বাজারে প্রভাব পড়েছে ঘুষ খোর আমলা ও সরকারি চাকরিজীবীদের কারণে। তারা নিজের বাড়িতে চাল মজুত করেন। যখন দাম বৃদ্ধি পায় তখন বাজারে বিক্রি করেন আর নিজের সংসারে কাজে লাগান। ফলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে একমাত্র বাজার মনিটরিং এর মাধ্যমে ।
গাইবান্ধার বাজার ও গাইবান্ধার জেলার লাগোয়া দিনাজপুর ও কুড়িগ্রামের কয়েকটি এলাকার চালের বাজারের এই চিত্র নিয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি মিল মালিক সমিতির নেতারা। চালকল ও মিল মালিক সমিতির মালিক পিপলু মিয়া বলেন, আমরা আছি শুধু ব্যবসা টিকিয়ে রাখছি। কখন বাজার দর কি হয় তা দেখার দায়িত্ব সরকারের থাকলেও বাজারে তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে কারণে মিলের গোডাউন থেকে বাজারে চালের দামের বেশ পার্থক্য আছে। চাল ব্যবসায়ী সমিতির নেতা সুদেব চন্দ্র জানান ,কয়েকদিনে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মালিকদের গোডাউনের চাল সরকার নিয়ন্ত্রণে আনলে বাজারে চালের দাম এতোটা বৃদ্ধি হতো না। কারন নতুন ধান ওঠার ভরা মৌসুমে কেজি প্রতি ৮ থেকে ১০ বৃদ্ধি হওয়ার পেছনে দায়ীদের খঁজে বের করতে না পারলে চাল ডিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ।
ধানসংকটে বন্ধ হচ্ছে
আশুগঞ্জের শতাধিক চাতালকল
ইসহাক সুমন, আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) থেকে জানান, হু হু করে বাড়ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে চালর দাম। চলতি বৈশাখ মাসে চালের বাজারে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) দাম বেড়েছে অন্তত ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। দেশের পূর্বাঞ্চলীয় হাওরের উৎপাদিত ধানের ওপর নির্ভর করে চলে এ মোকাম। সম্প্রতি উজান থেকে নেমে আসা পানিতে হাওরে তলিয়ে গেছে এবার হাজার হাজার বোরো ধানের জমি। ফলে চলতি বোরো মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দেশের বৃহত্তম হাওর অঞ্চলের এ মোকামে কমে গেছে ধানের আমদানি। তার পরও যে বোরো ধান আসছে তার গুণগত মান ভালো না। বাজার দরও বেশি। তারপর পাইকাররা এসব ধান ক্রয় করছে। আর এ কারণে এ ধানের চালের উৎপাদন হয় কম। তাই ধানের সঙ্গে চালের বাজারের মিল না থাকায় ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। ধানসংকট ও লোকসানের আশঙ্কাই আশুগঞ্জে চার শতাধিক চাতালকলের মধ্যে অর্ধেকই বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বৃহত্তম হাওর অঞ্চল পরিচিত কিশোরগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষকরা নৌকা দিয়ে প্রতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ মোকামে প্রতিদিনই নিয়ে আসে নতুন ধান। চলতি বোরো মৌসুমে নতুন ধানের তেমন আমদানি নেই। আর যেসব বোরো ধান আশুগঞ্জে আসছে তার মান ভালো না। অধিকাংশ ধান পচা ও কাঁচা। এসব ধান কিনতে আগ্রহী না পাইকাররা। তার পরও ক্রয় করছে তারা। আর কৃষকরা বলছে, উজান থেকে নেমে আসা পানি আর কাল বৈশাখি ঝড়ে পানিতে তলিয়ে গেছে হাওরের হাজার হাজার একর একর জমি। কৃষকদের দাবি, এবার বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদন করে তারা পথে বসেছে বলে জানান ধান বিক্রি করতে আসা কৃষক ও ধানের পাইকাররা।

আর মিলমালিকরা বলছেন, প্রতি বছর আশুগঞ্জ মোকামে প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ মন ধান আসত। কিন্তু এ বছর প্রতিদিন আসছে অন্তত ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার মন ধান। এর পরেও বাজারে যে ধান আমদানি হচ্ছে তা-ও অনেক নষ্ট। অন্যান্য বছরে যে ধান আসতো সেই শুকনো ধান প্রতি ৪০ কেজিতে চাল উৎপাদন হতো ২০ থেকে ২২ কেজি। বর্তমানে ভিজা ও পচা ধান আসায় প্রতি ৪০ কেজিতে চাল উৎপাদন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ কেজি। ধান সংকটের কারণে অনেক চাতালকল এখন বন্ধ রয়েছে।
চলতি বৈশাখ মাসে শুরুর দিকে চিকন চাল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ১৯৫০ থেকে ২০০০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু টানা বর্ষণে চাতালকলের উৎপাদন বন্ধ থাকায় ও হাওরে ধানিজমি তলিয়ে যাওয়ায় ধান সংকটের কারণে চালের বাজার বর্তমানে প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে চিকন চাল প্রতি বস্তা ২১৫০ থেকে ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বৈশাখ মাসের শুরুতে মোটা চাল প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) বাজারে ১৬০০ থেকে ১৬৫০ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে গিয়ে বস্তাপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৭৮০ থেকে ১৮০০ টাকা।
আশুগঞ্জ চাতাল কল মালিক সমিতি সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. শাহাজাহান সিরাজ জানান, উজান নেমে আসা পানির কারণে হাওরের ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে এবার প্রভাব পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ধানের মোকাম। বাজারের ধানের আমদানি কম থাকায় এবং কয়েক দিনের টানাবর্ষণের কারণে উপজেলা সবগুলো চাতালকল বন্ধ ছিল। এ কারণে চালের বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দাম বেশি থাকায় সরকারের খাদ্যগুদামে বর্তমান দামে চাল দিতে পারবে না মিল মালিকরা।
উল্লেখ্য, বৃহত্তর হাওরঅঞ্চল কিশোরগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ দেশের স্থান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ধান আশুগঞ্জ মোকামে আসে। আর এসব ধান স্থানীয় ৪ শতাধিক রাইস মিলে প্রক্রিয়াজাত করে চালে রূপান্তর করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর ও ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও নৌপথে সরবরাহ করে এসব এলাকার চালের চাহিদা পূরণ করা হতো।
সরকারের দামে চাল দিলে
কেজিতে দুই টাকা ভর্তুকি দিতে হবে
মিল মালিকদের
প্রতীক ওমর, উত্তরাঞ্চল ঘুরে জানান, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে চাল দিলে কেজিতে দুই টাকা ভর্তুকি দিতে হবে মিল মালিকদের। ফলে এবারের মৌসুমেও তালা ঝুলতে পারে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মিলের দরজায়। এমন আশঙ্কার কথাই জানিয়েছেন হাসকিং চালকল মালিকরা। উত্তর জনপদের নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ অঞ্চলের কৃষকরা স্বল্প পরিসরে ধান কাটা শুরু করলেও সরকারের বেঁধে দেওয়া ধান চালের দামের সঙ্গে সমন্বয় করতে হিমশিম খাচ্ছেন মিলাররা। তারা ভর্তুকি দিয়ে কিভাবে সরকারকে চাল দেবে এই নিয়ে মহা বিপাকে আছে।
ইতিমধ্যেই হাসকিং চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতারা সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নেতারা তাদের দাবি তুলে ধরেন। এতে চালের নির্ধারিত দাম ৩৪ টাকার জায়গায় ন্যূনতম ৩৬ টাকা নির্ধারণ করার দাবি জানান। কিন্তুকোনো অগ্রগ্রতি নেই।
উত্তরাঞ্চলের একাধিক হাসকিং চালকল মালিকরা বলছেন, বর্তমান বাজারে মোটা চালে সর্বসাকুল্যে খরচ পড়বে কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা। আর সরকার দাম নির্ধারণ করছে ৩৪ টাকা। এতে মিল মালিকদের প্রতি কেজি চালে কমপক্ষে ২ টাকা লোকসান গুণতে হবে। নিশ্চিত এই লোকসানের মুখে ফেলার জন্য মিলমালিকরা সরকারকে দুষছেন। তাদের অভিযোগ সরকার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে চালকল মালিকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। অপর দিকে চালকল মালিকরা ১১০ শতাংশ জামানত দিয়ে ধান নিয়ে চাল সরবরাহ করতে হয়। সরকারে বেঁধে দেওয়া জামানত এবং নির্ধারিত দামে চাল সরবরাহ সরকারে পক্ষ থেকে অলিখিত চাপ মনে করছেন মিলাররা।
এদিকে বগুড়া জেলার সবচেয়ে বেশি চালকল রয়েছে দুপচাঁচিয়া, নন্দীগ্রাম, সান্তাহার, নসরৎপুর, আদমদীঘি, শাজাহানপুর, গাবতলী, সোনাতলা, শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়া নওগাঁ জেলার রাণীনগর, আত্রাই, মহাদেবপুর, সাপাহারে। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। মূলত এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে চালকল মিল যা হাসকিং মিল নামে পরিচিত। বগুড়া জেলায় প্রায় ছোট-বড় ১৭০০ চালকল রয়েছে। আর সারা দেশে রয়েছে প্রায় ১৭০০০ চালকল মিল। এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ৫০০ অটো চালকল গড়ে উঠলেও বেশির ভাগ হাসকিং কল। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আড়াই লাখ চাতাল শ্রমিকের ভাগ্য। এসব মিল বন্ধ হলে শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। অনিশ্চয়তায় পড়বে এদের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোর ভাগ্য।
মৌসুম শুরুর আগে ব্যাংকগুলো মিলারদের ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি ব্যাংকের উচ্চ সুদের ঋণ, সরকারের নির্ধারিত রেটে ভর্তুকি দিয়ে চাল সরবরাহের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের এসব হাসকিং চালকলের অধিকাংশই বন্ধ হতে বসছে। সরেজমিনে এসব মিলের দেওয়ালে ব্যাংকের দায়বদ্ধতার সাইবোর্ড ঝুলতে দেখা যায়। দেনার দায়ে ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়েছে বগুড়ার হাসকিং চালকলগুলোর মধ্যে মাজেদ আলীর মামুন চালকল, আবদুল আলীমের কল্পনা চালকল, মাহফিন চালকল, মীম চালকল, তানিয়া চালকল, ভাইভাই চালকল, মাজেদা চালকল, বাপ্পি চালকলসহ প্রায় দেড় শতাধিক।
এদিকে বহুদিন ধরে চালকলকে শিল্প ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসলেও সরকারের পক্ষ থেকে সুদৃষ্টি পায়নি মিলাররা। মালিকদের ভাষ্যমতে এইখাতকে শিল্প ঘোষণা করলে তারা ব্যাংক থেকে অল্প সুদে শিল্প ঋণ নিয়ে ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে পারতো।
কথা হয় গাইবান্ধার বোনারপাড়া এলাকার হাসকিং চালকল মালিক মোকছেদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন সরকারে নির্ধাতির মূল্যে আমরা জিম্মি। ওই দামে চাল না দিলে মিলের লাইসেন্স বাতিল হবে। আর চাল দিলে চলতি মৌসুমে আনুমানিক বরাদ্দ ২৫ টনে তাকে ৫০ হাজার টাকা লোকসান গুণতে হবে।

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোবারক হোসেন বলেন, অন্যকোনো ব্যবসা জানা থাকলে মিল ব্যবসা ছেড়ে দিতাম। শেষ বয়সে কষ্ট করে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম মিলারদের ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন এই প্রবীণ ব্যবসায়ী।
এদিকে এখনো এই মৌসুমের ধান উঠা শুরু হয়নি অথচ এরইমধ্যে ২৪ টাকা কেজি দরে ধান এবং ৩৪ টাকা কেজি দরে চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ বছরের সরকার ৮ লাখ টন চাল এবং ৭ লাখ টন ধান গুদামজাত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। চালের পুরোটাই সরবরাহ করতে হবে মিলারদের। চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও বগুড়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক ঋণের কারণে জেলার দেড় শতাধিক হাসকিং মিল ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়েছে। যেসব মিল চালু আছে তারাও দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকার যদি মিলারদের জন্য সহায়ক না হয় তাহলে টিকে থাকা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন এই নেতা। মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, আমরা খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি এবং চালের দাম ন্যূনতম ৩৬ টাকা করার দাবি জানিয়েছি। তবে আমাদের দাবি না মানলে আমরা সারা দেশের মিলাররা এক সঙ্গে অনশনে যাবো। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হওয়ার কথাও জানান তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63916