৬ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:৩৭

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নামে বাড়ল ব্যাংক ঋণের সুদহার

বাড়বে ব্যবসা খরচ ও পণ্যের উৎপাদন ব্যয়

ব্যাংক ঋণের সুদহার আবারো বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতি ১০০ টাকার জন্য ব্যবসায়ীদের ব্যয় করতে হবে এখন ১১০ টাকা ৭০ পয়সা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নামে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লেও দিন শেষে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় নেতিবাচক প্রভাবই পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, ডলারের দাম বাড়ছে। গত এক বছরে শুধু আন্তঃব্যাংকেই প্রতি ডলারে প্রায় ৭ টাকা বেড়ে ১০৩ টাকা ৬২ পয়সা থেকে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা হয়েছে। যদিও বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এমনিতেই ডলার সঙ্কটের কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে, সেই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দেয়ায় ব্যবসা খরচ আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর ব্যবসা খরচ বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উন্নত দেশে ঋণের সুদহার বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ, ঋণের সুদহার বাড়লে উচ্চ সুদে ব্যবসায়ীরা ঋণ নেন না। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমে যায়। আর টাকার প্রবাহ কমে গেলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে যায়। এতে আপনা-আপনিই মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবের পর উন্নত অনেক দেশই ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়িয়ে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি খুব একটা কাজে আসে না। তার বাস্তব প্রমাণ হলো, গত দেড় বছরে ৬ বার নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সাথে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং বেড়ে গেছে। তার পরেও আবারো নীতিনির্ধারণ সুদহার এক লাফে পৌনে ১ শতাংশ অর্থাৎ ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সোয়া ৭ শতাংশ নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু এবারও এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি আমদানি-নির্ভর নয়। কিন্তু আমাদের দেশ তো আমদানি-নির্ভর। রফতানির চেয়ে আমদানি হয় বেশি। আমদানি-নির্ভর অর্থনীতিতে ঋণের সুদহার বাড়লে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। একেতো ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে, সেই সাথে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের সামগ্রিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। যার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতেও পড়বে বলে তারা মনে করছেন। অপর দিকে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা তা নেই, বরং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবমিলেই পণ্য মূল্য কমছে না বরং বেড়ে যাচ্ছে।

এ দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নীতিনির্ধারণী সুদহার এক লাফে পৌনে ১ শতাংশ বাড়ানোর ফলে নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে স্ট্যান্ডিং ল্যান্ডিং ফ্যাসিলিটি ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ হবে। এতে ব্যাংকগুলোরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার নিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, কোনো ব্যাংকের টাকার সঙ্কট হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়ে থাকে। এ জন্য আগে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদ গুনতে হতো। এখন সুদ গুনতে হবে সোয়া ৯ শতাংশ। ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেলে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাবে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল এক সার্কুলারের মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েছে। আগে সিক্স মানথ মুভিং এভারেজ রেট অফ ট্রেজারি বন্ড বা স্মার্ট রেটের সাথে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যুক্ত করে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হতো। এখন স্মার্ট রেটের সাথে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্ত করে ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সার্ট রেট রয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এর সাথে সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্ত করলে হবে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। তবে, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নানা সার্ভিস চার্জ যুক্ত করে প্রকৃত সুদহার আরো বেশি হয়ে যাবে। এমনিতেই ডলারের দাম বাড়ছে। এর ওপর ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে তাদের ব্যবসা খরচ আরো বেড়ে যাবে। এতে পণ্যের দাম বাড়বে। তাদের মতো, বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিলেই ডলারের সঙ্কট মিটে যাবে। আর ডলারের সঙ্কট কাটলে ডলারের দামও নিয়ন্ত্রণে আসবে। এতে আমদানি ব্যয় কমে আসবে। প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/782126