৬ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:৩৬

উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

ভারতের উত্তর সিকিমে অতি ভারী বর্ষণে সেখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ড্যাম (বাঁধ) ভেঙে সৃষ্টি হওয়া বন্যা পরস্থিতির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায়। অবিরাম বৃষ্টি আর ভারতের উত্তর সিকিমে ভয়াবহ বন্যা ও বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার নদী তীরবর্তী এলাকায় এলাকায় ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা। আবহাওয়া বিভাগ ও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, নিম্নাচাপের কারণে হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা পানি মিলিয়ে এই পরিস্থিতি অন্তত আরও দুই দিন অব্যাহত থাকবে। গত কয়েকদিন ধরেই ভারতের সিকিমে টানা বৃষ্টিপাত এবং মঙ্গল ও বুধবার মাঝরাতের পর অতি ভারী বৃষ্টি হয়। এতে করে তিস্তায় পানির পরিমাণ হঠাৎ করেই খুব বেড়ে যায়।

অন্যদিকে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেটের সবগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্যার আশঙ্কায় এই ৫ জেলার কর্মরত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ভারতের উত্তর সিকিমে তিস্তা নদীর চুংথাং ড্যাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উজানে তিস্তা নদীর পানি সমতলে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকাল ৯টায় তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, হঠাৎ আসা বন্যার পানিতে বুধবার উজানের ডালিয়া পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উপরে উঠে যায়। এতে করে উত্তরাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
আবহাওয়া পূর্বাভাস বলছে, আগামী দুইদিন উত্তরাঞ্চলেসহ সারাদেশে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এতে করে বন্যার পানি খানিকটা বাড়তে পারে। আপাতত যা দেখছি আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার নিচে থাকারই সম্ভাবনা আছে। তবে পানি আবার বৃদ্ধি পেতে পারে, বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছে চলে আসতে পারে।

এদিকে রংপুরের গঙ্গাচড়া তিস্তা পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও কাউনিয়া পয়েন্টে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহিদুল হক বলেন, কাউনিয়া পয়েন্টে সকাল ৯টায় বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। ঢুস মাড়ার চড় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষি জমিতে পানি উঠেছে। তবে এখনো বাড়ি ঘরে কোথাও পানি উঠেনি। কাউনিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। সকল ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।

আর গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না জানান, তিস্তার গংগাচড়া পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে লক্ষিটারী ইউনিয়নের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় লক্ষিটারীর পূর্ব অংশ প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় যেন মানুষের জানমালের ক্ষতি না হয়, সে লক্ষ্যে প্রশাসন কাজ করছে।

অন্যদিকে এদিকে গাইবান্ধায় তিস্তা নদী এলাকায় আকস্মিক বন্যা হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে গাইবান্ধা জেলার তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হতে পারে। একইসঙ্গে আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকায় তিস্তা নদীর বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামে তিস্তার পানি আরও বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কার স্থানীয়দের।

টানা বৃষ্টিতে পানির নিচে রাজশাহী : রাজশাহীতে একটানা বৃষ্টি চলছে। বুধবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হয় এ জেলায়। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণই নেই। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) দুপুরেও বৃষ্টি চলছিলো। এই বৃষ্টিতে পানির নিচে চলে গেছে রাজশাহী। শহরের সব সড়কে হাঁটু সমান পানি জমেছে।

এছাড়া নিম্নাঞ্চলগুলোতে ঘরবাড়ির ভেতরে পানি ঢুকে গেছে। এ জন্য অপরিকল্পিত নগরায়নকে দুষছেন নগরবাসী। তবে আবহাওয়া অফিস বলছে, বৃষ্টির পরিমাণও কম নয়। গত ১০ বছরেও রাজশাহীতে এমন বৃষ্টি হয়নি।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দুপুর ১টা থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে বেশি বৃষ্টি হয়েছে বুধবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত। অবশ্য সকাল থেকেও বৃষ্টি থামেনি।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, তারা ২০১৩ সাল থেকে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের তথ্য আলাদা করে সংরক্ষণ করেন। সেই তালিকায় দেখা যাচ্ছে, এবারের বৃষ্টিপাতই সর্বোচ্চ।

এর আগে ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯৯ মিলিমিটার, ২০১৪ সালের ২৭ মে ৯৮ দশমিক ৩ মিলিমিটার, ২০১৫ সালের ২৬ জুন ১০০ মিলিমিটার, ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল ১০২ মিলিমিটার, ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই ১০৭ দশমিক ২ মিলিমিটার, ২০১৮ সালের ১ মে ৬৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার, ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর ৭৮ মিলিমিটার, ২০২০ সালের ২১ মে ৮১ মিলিমিটার ও ২০২১ সালের ২১ জুলাই ১১১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল।

এবারের বৃষ্টির কারণে শহরের লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, ঘোষপাড়া, সাহেববাজার, গণকপাড়া, কাদিরগঞ্জ, বর্ণালী মোড়, উপশহর, টিকাপাড়াসহ সব এলাকায় পানি জমেছে। জমে থাকা পানির পরিমাণ কোথাও হাঁটুসমান আবার কোথাও কোমরসমান। শহরের টিকাপাড়া এলাকায় সকালে সড়কের ওপর দিয়ে নৌকা চলাচল করতে দেখা গেছে।

এই বৃষ্টির কারণে অনেকে জাল দিয়ে সড়কে মাছ ধরতে শুরু করেছেন। তবে বেকায়দায় পড়েছেন তারা, যাদের বাড়িতে এমনকি ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। শহরের বাইরের গ্রামাঞ্চলে বৃষ্টির কারণে পুকুর উপচে পানি চলে যাচ্ছে বিলে। এতে ভেসে যাচ্ছে পুকুরের মাছ।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, এখন বৃষ্টির সময়। বৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে একদিনে হঠাৎ করেই এত বৃষ্টি অস্বাভাবিক। এখনও আকাশ মেঘলা আছে। বৃষ্টিও হচ্ছে। থেমে থেমে এ রকম বৃষ্টি চলার সম্ভাবনা রয়েছে।
গতকাল সকালে তিস্তার পানি রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে তিস্তা নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, কাপাসিয়া, বেলকাসহ কয়েকটি ইউনিয়নে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে।
এ ছাড়া পানি ঢুকছে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়ন ও ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়াসহ কয়েকটি নিম্নাঞ্চলসহ চরাঞ্চলে। পানি ঢুকে পড়ায় এসব এলাকার উঠতি আমন ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমি তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বাড়িঘর ও গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রসহ নিরাপদ জায়গায় ছুটে যান।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক : এদিকে হঠাৎ বন্যায় তিস্তার চরাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও দমকা বাতাসে বিপাকে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। গরু-ছাগল নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউবা উঁচু রাস্তায়। উৎকণ্ঠায় রাত পার করলেও পানি নেমে যেতে শুরু করায় এখন কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে বন্যা পরবর্তী ভাঙনের আশঙ্কায় রয়েছেন তিস্তাপাড়ের হাজারো মানুষ।

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন এলাকার ফজর আলী বলেন, চরে ৫ দোন জমিতে রোপা আমন ধান করেছি, ধান কাটার সময়ও চলে আসছে। হঠাৎ পানি আসায় সব ডুবে আছে। কতটুকু ধান থাকবে বলা মুশকিল। একই এলাকার কৃষক আমিনুর রহমান বলেন, চরে কয়েকদিন আগে ধান কেটে রেখেছি। হালকা বৃষ্টি হওয়ায় বাড়িতে নিয়ে আসিনি। পানি আসার খবরে কোনো রকমে ভেজা ধান নিয়ে আসছি। বৃষ্টি পড়ছে। তাই ধান মাড়াই করতেও পারছি না।

আদিতমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, বন্যার পানিতে চরের সবজিক্ষেত, আলু, রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে আছে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের লোকজন কাজ করছে। এখনো ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জি আর সারোয়ার বলেন, বন্যাদুর্গত মানুষদের খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা হবে। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, তিস্তার দোয়ানি পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করায় আদিতমারী ও লালমনিরহাট সদর বন্যার আশঙ্কামুক্ত। আমরা সার্বিক খোঁজখবর রাখছি।

এদিকে, বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন গাইবান্ধা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখার কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (এনডিসি) জুয়েল মিয়া।

তিনি জানান, নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষদের সতর্ক করতে মাইকিং করা হয়েছে। মানুষকে গরু-ছাগলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সতর্ক থেকে নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্র বা ফ্ল্যাট শেল্টারে অবস্থান নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। জরুরি যোগাযোগে নৌকার ব্যবস্থা রাখাসহ চালু করা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। বন্যাকালীন মানুষদের জন্য জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/537283