৫ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৩২

বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ভাবনা

অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করীম

৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও তাদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কোর মাধ্যমে বিশ্বের ১০০টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে ইউনেস্কো প্রতি বছর একটি করে স্লোগান বা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘শিক্ষকতা পেশার গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী আলোচ্যসূচির শীর্ষে রাখা।’

জাতিসঙ্ঘের অংশ হিসেবে এর মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং মূল অংশীদারদের সমন্বয়ে, ইউনেস্কো মানবাধিকারের মৌলিক অবদান এবং আন্তর্জাতিক শান্তি বিনির্মাণ ও রক্ষার জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। একজন শিক্ষকের জন্য তার এই মহান পেশা অন্যদের জীবনে উন্নত নৈতিক চরিত্র সৃষ্টি করা ও মানবিক গুণাবলির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব তৈরি করার অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে। টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনে অবদান রাখে এবং ব্যক্তিগত পরিপূর্ণতা প্রদান করে। বর্তমানে বাংলাদেশ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছে যা আর্থিক স্বল্পতা ও মর্যাদার পতনের কারণে হয়েছে।

বর্তমানে যখন প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়, তখন সারা বিশ্বেই শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব দৃশ্যমান। বেশ কয়েকটি কারণে তা হচ্ছে। বিশেষ করে কাজের চাপ বৃদ্ধি, বেতন-ভাতার অসামঞ্জস্য ও মর্যাদার ঘাটতির কারণে শিক্ষকতা পেশা তার আবেদন হারাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে বিশ্ব ও সংশ্লিষ্ট দেশকে বিভিন্নভাবে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পক্ষে সমর্থন করতে হবে এবং তাদের চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করে, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের আকৃষ্ট করতে হবে। তা ছাড়া তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার জন্য অনুপ্রেরণামূলক অনুশীলনগুলো প্রদর্শন করাও জরুরি। যে উপায়ে শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ, সম্প্রদায় এবং পরিবারগুলো শিক্ষকদের স্বীকৃতি দেয়, প্রশংসা করে ও সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে তা আরো ব্যাপকতর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকে আমরা জানতে পারি, শিক্ষকতা পেশা বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় পেশা নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে চাকরিরত বেশির ভাগ শিক্ষকও মনে করেন, শিক্ষকতা পেশা কোনোভাবেই আকর্ষণীয় নয়। আবেগের সাথে তাদের পেশা গ্রহণ করা সত্ত্বেও, কর্মক্ষেত্রের অবনতি এবং স্কুলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে শিক্ষকরা প্রায়ই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেয়ার কারণগুলো হচ্ছে- ক. প্রশাসন, পরিবার ও শিক্ষকদের নিজেদেরই উৎসাহহীনতা; খ. স্বীকৃতি ও সম্মানের অভাব এবং গ. জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় শিক্ষকদের বেতন-ভাতার অপর্যাপ্ততা।

তাই এই বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ও বেতন-ভাতা উন্নতির মাধ্যমে শিক্ষকতার প্রতি বিদ্যমান অনীহা দূর করার আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে উদযাপনগুলোতে একজন শিক্ষকের জীবনের বা পেশাগত অর্থপূর্ণতার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং যোগ্য তরুণদেরকে শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট ও ধরে রাখার গুরুত্বের ওপর ফোকাস করতে হবে। শিক্ষাদান কর্মসূচিতে যুবকদের আকৃষ্ট করা এবং শিক্ষকদের অস্বস্তি রোধ করার জন্য বর্তমানে যারা পেশায় নিয়োজিত তাদের পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিক মান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।

ইউনেস্কো, আইএলও, ইউনিসেফ ও এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ব শিক্ষক দিবসের চারটি সহ-আহ্বায়ক সংস্থার সিদ্ধান্তের আলোকে বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশাকে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশে জাতীয় নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমে এই পেশাকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন- মিটিং, প্রদর্শনী, প্রচারাভিযান, শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে সম্মাননা প্রদান ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব ব্যবস্থা জনসমক্ষে তুলে ধরার মাধ্যমে আমরা শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব তুলে ধরতে পারি।

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে থাকে তবে শিক্ষক হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। তাই শিক্ষকরা সমস্যায় থাকলে শিক্ষার গুণগতমান রক্ষা করা যাবে না। সেটি অসম্ভব। আমরা মনে করি, শিক্ষকদের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রের সব ধরনের সমস্যা ও বৈষম্য দূর করে একটি পরিকল্পিত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ অবশ্যই সৃষ্টি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/781778