৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ১০:১০

খেলাপি ঋণভারে জর্জরিত ব্যাংকিং সেক্টর : দায় কার?

-এম এ খালেক

আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক টাকাও বাড়বে না। অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্য শোনার পর অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংক সংশ্লিষ্টগণ আশার আলো দেখেছিলেন। কারণ অর্থনীতি, যিনি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্বে নিয়োজিত তার কথায় আস্থা রাখাটাই স্বাভাবিক। এছাড়া অর্থমন্ত্রী নিজেও একজন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা। কাজেই তিনি দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবহিত আছেন। তাই তার কথায় কেউই অনাস্থা প্রকাশ করেননি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেননি। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে এমন সব নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যা দীর্ঘ মেয়াদে এই খাতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, যদিও এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে কিছুটা কমিয়ে দেখানো সম্ভব হয়েছিল। দেশের একজন বরেণ্য অর্থনীতিবিদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে ঘর পরিষ্কার দেখানোর নামান্তর মাত্র। এসব ব্যবস্থার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কৃত্রিমভাবে কিছুটা কম দেখানো গেলেও এতে অবস্থার বাস্তব উন্নতি হবে না। তিনি ঋণ খেলাপিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের পরিবর্তে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা। কাজেই তার নিকট জাতির আশা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সেই আশা তিনি পূরণ করতে পারছেন না বলেই মনে হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবার জন্য যা যা করণীয় তা করা হয়েছে। এমন কিছু আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে যা আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। খেলাপি ঋণ কমানোর পরিবর্তে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের এমন সব সুবিধা দেয়া হয়েছে যা তাদের আরো বেশি করে ঋণ খেলাপি হবার জন্য প্রলুব্ধ করেছে।

যে কোনো দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের অস্তিত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও খেলাপি ঋণের একটি সহনীয় মাত্রা থাকে। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ঋণ খেলাপের অর্থ হচ্ছে ব্যাংক এবং গ্রাহকের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঋণ চুক্তির শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পারা। ব্যাংক সাধারণত কাউকে ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে চায় না। কোনো ঋণ গ্রহীতা নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি ফেরৎ দিতে না পারলে ব্যাংক তাকে ঋণের কিস্তি ফেরৎদানের জন্য সামর্থ্যবান করে তোলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও যদি ঋণ গ্রহীতা কিস্তির অর্থ ফেরৎ দিতে না পারেন তাহলে তাকে এক সময় ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যে কোনো দেশেই দু’ ধরনের ঋণ খেলাপি প্রত্যক্ষ করা যায়। একশ্রেণির ঋণ খেলাপি আছেন যারা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণ খেলাপি। এদের যদি আর্থিক বা নৈতিক সহায়তা প্রদান করা হয় তাহলে তারা এক সময় ঠিকই ব্যাংকের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে সক্ষম হন। যারা প্রকৃত ঋণ খেলাপি তাদের নানাভাবে সহায়তা প্রদান এমনকি প্রয়োজনে নতুন করে ঋণ দিয়ে হলেও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান করে তোলা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের কালচার হচ্ছে উল্টো। যারা প্রকৃত ঋণ খেলাপি তাদের কার্যত কোনো সহায়তা প্রদান করা হয় না। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করার পর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গৃহীত ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেন না তারাই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা অত্যন্ত পাওয়ারফুল এবং এরা সব সময়ই সরকারের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকতে পছন্দ করেন। যেহেতু এরা সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকেন তাই তাদের কিছু করার ক্ষমতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের থাকে না। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করবেন এবং সেই ঋণের অর্থ নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার না করে অন্য খাতে প্রবাহিত করবেন। এমনকি কেউ কেউ ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কথায় বলে, বাঁধের উজানে কেউ যদি পানি ঘোলা করে তাহলে সেই ঘোলা পানিই ভাটিতে প্রবাহিত হবে। তাই ভাটিতে যদি পরিচ্ছন্ন পানি পেতে হয় তাহলে উজানে যে বা যিনি পানি ঘোলা করছেন তাকে সরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় কোনোভাবেই ভাটিতে স্বচ্ছ পানি আসবে না। ব্যাংকিং সেক্টরের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। যারা রাজনৈতিক প্রভাবাধীন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা না গেলে কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো যাবে না। কিছু দিন আগে শোনা গিয়েছিল, ব্যাংকিং সেক্টরের ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদিতে বয়কট করা হবে। তাদের সামাজিকভাবে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আইন আর করা হয়নি। আগামীতেও যে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো কোনো দেশে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের রাজধানী শহরে বসবাস করতে দেয়া হয় না। তাদের সন্তানদের রাজধানীর কোনো স্কুলে ভর্তি করতে দেয়া হয় না। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করা হয়। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা দেশ ও জাতির শত্রু। তাই তাদের কঠোর বিচারের আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা যেতে পারে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের স্বনামে-বেনামে থাকা সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। এমনকি তাদের নিকট আত্মীয়ের নামে (যেমন স্ত্রী,বাবা-মা, সন্তান, ভাই) থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হলে তারা যাতে ভবিষ্যতে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে না পারে তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মাঝে মাঝে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের তালিকা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপের প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

আমাদের দেশের কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের প্রতি বড়ই উদার। তাদের এমন সব সুবিধা দেয়া হয়েছে যা নৈতিকতার বিচারে কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যেখানে একজন ঋণ গ্রহীতা ঋণ খেলাপি হবার জন্য উৎসাহিত বোধ করেন। মাঝে মাঝেই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের সুদ মওকুফ সুবিধা দেয়া হয়। অনেকেই ভুলবশত বলে থাকেন, ব্যাংক অমুক উদ্যোক্তা বা ঋণ গ্রহীতার ঋণ মওকুফ করেছে। কিন্তু এই কথাটি মোটেও ঠিক নয়। ব্যাংক কোনো অবস্থাতেই মূল ঋণ বা প্রিন্সিপাল লোন মওকুফ করতে পারে না। ব্যাংক যেটা করে তা হলো সুদ মওকুফ। কিন্তু এখানেও সমস্যা রয়েছে। কোনো নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারির ক্ষেত্রে কিন্তু ব্যাংক সুদ মওকুফ করে না। তারা ঋণ খেলাপি, বিশেষ করে যেসব ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হয় সেই সব হিসাব থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদ মওকুফ করে থাকে। এই সুদ মওকুফ প্রক্রিয়া সুফল দিচ্ছে না বরং মন্দ ফল দিচ্ছে এবং নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারিদের খেলাপি হতে উদ্বুদ্ধ করছে। কেউ একজন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৫ বছরে ১০ কোটি টাকা মূল ঋণ এবং সুদ বাবদ পরিশোধ করে যদি কোনো বিশেষ সুবিধা বা সুদ মওকুফ সুবিধা না পান এবং তার পাশাপাশি একজন ঋণ খেলাপি ১০ কোটি টাকা ৫ বছর আটকে রেখে যদি ২ কোটি টাকা সুদ মওকুফ সুবিধা পান তাহলে কেউ কি নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধে উৎসাহী হবেন? একমাত্র নির্বোধ ব্যক্তি ছাড়া কেউ এই অবস্থায় নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধে আগ্রহী হবেন না। বাংলাদেশে ঠিক এই অবস্থাই চলছে। একজন ঋণ খেলাপিকে কিভাবে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে তার কিছু কাহিনী উল্লেখ করা যেতে পারে।

২০২০ এবং ২০২১ সালে করোনাকালিন অবস্থার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সব ঋণ গ্রহীতাদের জন্য একটি বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। সেই সময় কোনো ঋণ গ্রহীতা তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলেও তাদের ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। এই অবস্থায় যারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি তারাও ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হননি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক আবারো ঋণ খেলাপিদের ছাড় দেয়। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়, কোনো ঋণ গ্রহীতা তার মোট কিস্তির অর্ধেক অর্থ জমা দিলেও তাকে আর ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে না। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এক বছর পর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে রহস্যজনকভাবে আন্দোলনের নামে জ¦ালাও-পোড়াও শুরু হয়। কারা এই সহিংস কার্যক্রম চালায় তা নিয়ে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। তবে সেই আন্দোলনের কারণে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সময় একটি নতুন আইনি কার্যক্রম শুরু করে। তারা ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ অঙ্কের বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের ঋণ হিসাব পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্যাংকের প্রচলিত আইন মোতাবেক কোনো ঋণ হিসাব তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলিকরণ করা যায় না। ঋণ হিসাব পুনর্গঠনের নামে যাদের ঋণ হিসাব পুন:তফসিলিকরণ করা হয় তাদের বেশির ভাগের ঋণ হিসাব তার আগেই তিনবার পুনঃতফসিলিকরণ করা হয়েছিল। কাজেই তাদের বিশেষ সুবিধা দেবার জন্য ঋণ হিসাব পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। মোট ১১টি উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ঋণ হিসাব থেকে শর্ত মোতাবেক কিস্তি আদায় হয়নি। মাত্র দু’টি শিল্পগোষ্ঠী তাদের ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেছে। সেই সময়ই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল যে, রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে শুধু কি ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ ঋণ খেলাপিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? যারা এর চেয়ে কম অঙ্কের ঋণ খেলাপি তাদের কি কোনো ক্ষতি হয়নি? যদি সুবিধা দেয়া হবে তাহলে সবার জন্যই তা অবারিত করা উচিত ছিল। আগে উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর কোনো একটি প্রকল্প ঋণ খেলাপি হলে সেই গোষ্ঠীর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ পেতো না। কিছু দিন আগে জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হয়েছে। এখন কোনো একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলে সেই গোষ্ঠীর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঋণ প্রাপ্তিতে কোনো অসুবিধা থাকবে না। অর্থাৎ ঋণ খেলাপিদের নতুন করে ঋণ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করার পর ঋণ খেলাপিদের অনুকূলে যে আইনি সুবিধা প্রদান করেন তা ছিল দেশের ইতিহাসে নজীরবিহীন একটি সুযোগ। মাত্র ২ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেয়া হয়। এই উদ্যোগের ফলে খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায় না করেও কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। আগে কোনো ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করতে হলে প্রথমবারের জন্য ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বারের জন্য ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বারের জন্য ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ব্যাংকে নগদে জমা দিতে হতো। আরো কয়েকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে। আগে ঋণ হিসাব অবলোপনের নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে করে সেই ঋণ হিসাব অবলোপন করা যেতো। এখন কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হবার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাচ্ছে। শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান তুলে নেয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ যদি ৫ লাখ টাকা বা তার কম হয় তাহলে মামলা দায়ের করতে হবে না। অনেকের মধ্যে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করার অর্থ হচ্ছে সেই ঋণের দাবি ব্যাংক পরিত্যাগ করে। এটা মোটেও সঠিক ধারণা নয়। ঋণ হিসাব অবলোপনের মর্মার্থ হলো, ব্যাংকের লেজারকে ক্লিয়ার দেখানো। ব্যাংক কখনোই অবলোপনকৃত ঋণের দাবি ত্যাগ করে না। সাধারণ ঋণের মতোই এই ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের জন্য ব্যাংক সচেষ্ট থাকে। তবে ব্যাংক ধরে নেয় অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে হয়তো কিস্তি আদায় হবে না। তাই অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে কোনো কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফায় যুক্ত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করছে তা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ প্রদর্শিত খেলাপি ঋণের মধ্যে পুনঃতফসিলিকৃত ঋণাঙ্ক, অবলোপনকৃত ঋণাঙ্ক এবং মামলাধীন প্রকল্পের নিকট পাওনা ঋণকে যুক্ত করা হয়নি। তারপরও ঋণের যে পরিসংখ্যান প্রদর্শন করা হচ্ছে তা ভয়াবহ রকমের উদ্বেগজনক। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতায় আসীন হন তখন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ২০২২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকায়। এ বছর জুন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে মামলাধীন প্রকল্পসমূহের নিকট ব্যাংকের দাবিকৃত পাওনা অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ কোটি টাকার মতো। অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ হিসাব। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ছাড়কৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ প্রদর্শন করলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশের কম হবে না।

আমরা খেলাপি ঋণ নিয়ে কথা বলি কিন্তু আমাদের মনোভাব হচ্ছে স্বেচ্ছাচারমূূলক। যারা ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয়ের জন্য দায়ী সেই সব বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের প্রতি আমরা জাতীয়ভাবে বড়ই উদার। তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। তাদেরকে লালন পালন করাই আমাদের কর্তব্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু যে কৃষক ৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন তাকে আমরা দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করতে পারি। এটাই আমাদের স্বভাব। বিচারের বাণী এখন নীরবে নিভৃতে কাঁদে না, প্রকাশ্যে বিলাপ করে কাঁদে। রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত বৃহৎ ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে যদি কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না যায় তাহলে কোনোদিনই ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে না।

https://www.dailysangram.info/post/537054