৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:৩৭

আটকে গেলেন ‘রাজনৈতিক’ বিবেচনায়

৩৫তম বিসিএসের ৮৮ জন যোগ দিতে পারলেন না

‘দিনটি হতে পারত আমাদেরও। আমরাও হয়তো ফেসবুকে পোস্ট দিতাম, পরিবারে হাসি ফুটত। কিন্তু হয়নি। এই না হওয়ার কষ্টটা কেবল যারা ভুক্তভোগী, তারা ছাড়া কেউ কখনোই বোঝেনি, বোঝে না, বুঝবেও না।’
৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিতে যোগ দিয়ে গতকাল বন্ধুরা যখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করছেন, তখন এভাবেই ফেসবুকে লিখে হতাশা প্রকাশ করেছেন এই বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার পাওয়া একজন প্রার্থী। তাঁর মতো হতাশায় আছেন আরও ৮৭ জন।

তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫৫ জন অভিযোগ করেছেন, তাঁদের রাজনৈতিক বিবেচনায় আটকে দেওয়া হয়েছে। আড়াই লাখ প্রতিযোগীর সঙ্গে মেধার প্রতিযোগিতা করে তাঁরা মনোনীত হয়েছিলেন। এখন পুনরায় যাচাই করে ইতিবাচক প্রতিবেদন এলে তবেই তাঁদের চাকরি হবে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি জারি করে পিএসসি। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক সব পরীক্ষা শেষে ২ হাজার ১৮৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে পিএসসি। ৮ মাস পর গত ২ এপ্রিল নিয়োগের চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। তাতে মোট ১০১ জন বাদ পড়েন। তাঁদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাদ পড়েন পুলিশ যাচাইকরণে নেতিবাচক প্রতিবেদনের জন্য।
কী যাচাই করে পুলিশ?
পিএসসি বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর শুরু হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গেজেট প্রকাশের পালা। মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশের আগে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে ‘পুলিশ যাচাইকরণ’ করে। এই যাচাইকরণের কাজটি সাধারণত করে থাকে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। তবে গত কয়েক বছর অন্য গোয়েন্দা সংস্থা দিয়েও কাজটি করানো হয়েছে।
পিএসসি ও মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজন প্রার্থীর প্রাক্-যাচাই ফর্মে দেওয়া ১৬ ধরনের তথ্য যাচাই করা হয়। শিক্ষার্থীরা কোথায় লেখাপড়া করেছেন, সর্বেশষ পাঁচ বছর কোথায় থেকেছেন—এ রকম সাধারণ তথ্যের পাশাপাশি তিনি কোনো ফৌজদারি বা অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত বা দণ্ডিত হয়েছেন কি না, এই তথ্য চাওয়া হয়। এসব যাচাই শেষ করে বিশেষ শাখার পুলিশ সুপার ও ডিআইজি মর্যাদার একজন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে প্রতিবেদন পাঠান। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাই করার কথা না থাকলেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রার্থীর পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়ও যাচাই করে থাকে বলে জানা গেছে।

অভিযোগ আছে, এ রকম ‘রাজনৈতিক বিবেচনার’ প্রতিবেদনের কারণে গত কয়েকটি বিসিএসে শতাধিক প্রার্থীর নিয়োগ আটকে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিএসসির কাজ চূড়ান্ত ফল তৈরি করে সুপারিশ করা। যাচাইয়ের পর গেজেট প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে পিএসসির কিছু করার নেই।’
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যা করছি, নিয়মনীতির মধ্যেই করছি।’
যাঁরা এবার আটকে গেলেন
৩৫তম বিসিএসে নিয়োগবঞ্চিত ৮৬ জনের মধ্যে ৬৫ জন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ১৪ জন, পুলিশ ক্যাডারের ৬ জন, স্বাস্থ্য ক্যাডারের ১৫ জন, শিক্ষা ক্যাডারের ২৬ জনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদে অভিযোগ, শুধু ফৌজদারি মামলার বিষয়টা দেখার কথা থাকলেও তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, প্রার্থীর বাবা-মা, ভাইবোন বা নিকটাত্মীয়ের নামে মামলা আছে কি না, তাঁদের কেউ বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কি না—এসব বিষয়ও পুলিশ যাচাইয়ে দেখা হয়েছে।

বঞ্চিত ব্যক্তিদের মধ্যে পুলিশ ক্যাডারের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আট বছর বয়সে বাবা মারা যান। বাবা বিএনপির সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর গত ২০ বছরে আমাদের পরিবারের কেউ রাজনীতি করেনি। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের চার ভাইবোনকে মানুষ করেছেন। আমার বিসিএস পাসের খবরে পুরো পরিবার নতুন জীবন পেয়েছিল। কিন্তু গেজেটে আমার নাম এল না। আমার অপরাধটা কী?’
সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটিতেই প্রথম হওয়া এক নারী প্রার্থী বলেন, তাঁর বাবা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। পারিবারিক বিরোধকে পুঁজি করে তাঁকে ও তাঁর বাবাকে জামায়াত বলে অভিযোগ তোলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এতে তাঁর চাকরি আটকে গেছে।
শিক্ষা ক্যাডার পাওয়া চট্টগ্রামের এক ছেলে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স দুটিতেই প্রথম শ্রেণি পেয়েছি। বাবা বিএনপির সমর্থক। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমার বাবাকে অনেকগুলো মিথ্যা মামলার আসামি করা হয়। বাবা মারা গেছেন চার মাস আগে। অথচ এখনো বাবার বিরুদ্ধে মামলা আছে বলে আমাকে নিয়োগবঞ্চিত করা হলো।’ আরেকজন বলেন, তাঁর বাবা আইনজীবী হিসেবে কিছু জামায়াত-সমর্থকের হয়ে মামলা লড়েছেন। এটাই কাল হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি অপরাধ ছাড়া একজনকেও আটকে দেওয়া ঠিক নয়। এটা অন্যায়। এটা অনৈতিক চর্চা। এই সংস্কৃতি বন্ধ করা উচিত।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1166461