৩ মে ২০১৭, বুধবার, ৯:১৯

শতফুল ফুটতে দাও

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হলে আখেরে সবাই পরাজিত হয়

একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক গত ২৯ এপ্রিল ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা- বৈশ্বিক সূচকে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছেপেছে। এর সূচনায় লেখা হয়েছে, ‘গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে আরও সংকুচিত হয়েছে, তা অনুধাবন করার জন্য বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার পর্যবেক্ষণের দিকে না তাকালেও চলে। এ দেশের গণমাধ্যমে কর্মরত পেশাদার সাংবাদিক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী নাগরিক পর্যন্ত প্রত্যেকেই তা উপলব্ধি করছেন। তথাপি প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) সর্বসাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আমলে নেয়া প্রয়োজন।’

আরএসএফের প্রতিবেদন বলছে, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত এক বছরে দুই ধাপ নিচে নেমে গেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ভালো থেকে খারাপের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪৬তম। আগের বছর আমাদের স্থান ছিল ১৪৪তম।’

গত ২-৩ দশক ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন সংস্থা বিশ্বের দেশগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের সূচক প্রকাশ করে আসছে। এসব সূচক নির্ণয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও এগুলোকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। Human Development Index, Global Competitiveness Index, Cost of Doing Business Indexmn বহু রকমের সূচক প্রতি বছরই প্রকাশিত হচ্ছে। এরকম সূচক প্রকাশের রেওয়াজ আগে ছিল না। বিশ্বায়নের সর্বসাম্প্রতিক পর্ব সূচিত হওয়ার পর থেকে এ রকম সূচক প্রকাশের রেওয়াজ শুরু হয়েছে। এর একটি বড় কারণ হল বিশ্বায়িত পৃথিবীতে কোন্ দেশ কী অবস্থানে রয়েছে তা বিশ্বায়ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর জানা প্রয়োজন। এসব সূচক শুধু মানুষকে সচেতন করার জন্যই তৈরি করা হয় না, এগুলোর একটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের ক্ষমতাধর শক্তিগুলোকে পররাষ্ট্রনীতিসহ বিভিন্ন নীতি নির্ধারণের জন্য ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া। কাজেই এসব সূচককে রাজনীতি কিংবা মতাদর্শমুক্ত বলা যায় না।

অনেক সূচকের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সূচক হচ্ছে Failed State Index। এ সূচকের মাধ্যমে জানান দেয়ার চেষ্টা করা হয় কোন্ রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নির্ণয়ের জন্য অনেক অনুঘটককে ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্রের অভাব, গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি, জাতিগত সংঘাত, দুর্নীতি, সুশাসনের অনুপস্থিতিসহ আরও অনেক কিছু। একটি রাষ্ট্র যখন ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার পথে এগিয়ে যায় তখন এর জন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং সেই রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর অভীপ্সা এ উভয় কারককে দায়ী করা যায়। একসময় ইরাক ও লিবিয়া উভয় রাষ্ট্র ছিল খুবই স্থিতিশীল। অবশ্য এসব রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে নাগরিক স্বাধীনতা না থাকার জন্য প্রচণ্ড মনোকষ্ট ছিল। কিন্তু এ সত্ত্বেও রাষ্ট্র দুটি রাষ্ট্রের অতি মৌলিক ও প্রাথমিক দায়িত্ব অর্থাৎ জনজীবনে নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিদেশি আগ্রাসনের কবলে পড়ে দুটি রাষ্ট্রেরই মহাসর্বনাশ ঘটে। দুটি রাষ্ট্রেই ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের পতন হয় এবং উভয়েই অস্বাভাবিক মৃত্যুবরণে বাধ্য হয়। পবিত্র ঈদের দিনে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিকে হত্যা করে অজানা মরু প্রান্তরে সমাহিত করা হয়। এতে দেশ দুটিতে গণতন্ত্রও আসেনি, শান্তিও আসেনি। দেশ দুটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পাঠককে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। বিশ্বায়নের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণাও সংকুচিত হয়ে গেছে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র নানা ধরনের আন্তর্জাতিক আইন ও অবরোধের কবলে পড়ছে। একসময় বলা হতো, কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ কিংবা নাক গলানো সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের শামিল। অথচ এখন এরকম হস্তক্ষেপ অহরহই ঘটছে। বিশ্বায়নসৃষ্ট এ রীতি মানবজাতিকে কতটুকু স্বস্তি ও নিরাপত্তা দিচ্ছে তা এক বিরাট প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।

একটি রাষ্ট্র কোন্ ধরনের সমাজব্যবস্থা বেছে নেবে এবং কাদের দ্বারা শাসিত হবে সে বিষয়টি সেই দেশের জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত। জনগণের ওপর আস্থা রাখলে অবশ্যই মেনে নিতে হবে কোনো অপ্রিয় বা স্বৈরশাসক দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে পারলেও শেষ পর্যন্ত জনগণের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে তাকে বিদায় নিতে হয়। স্পেনের ফ্রাঙ্কো, পর্তুগালের সালাজর এবং ফিলিপাইনের মার্কোসকে জনরোষের মুখেই ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, স্বৈরশাসন কিংবা একনায়কতান্ত্রিক শাসন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তবে কখনও চিরস্থায়ী হতে পারে না। স্বৈরশাসকের দীর্ঘস্থায়ী শাসনামলে অনেক নাগরিককে দুঃখ-দুর্দশা, নিপীড়ন নির্যাতন এবং অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়। এ অবস্থাকে আমরা বলতে পারি চৎরপব ড়ভ খরনবৎঃু। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে এর চেয়ে বহুগুণ মূল্য দিতে হয়। নিত্যদিন ইরাকে যা ঘটছে তা আমাদের ব্যর্থ রাষ্ট্রের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করছে। দেশের ভেতরে যত মতপার্থক্য কিংবা বিবাদ-বিসংবাদ কিংবা একে অপরকে হননের ঘটনা ঘটুক না কেন, এগুলো নিজেরাই শান্তিপূর্ণভাবে মিটমাট করে ফেলাই বেহেতর। অন্যথায় এর ভবিষ্যৎ পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে, যার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত নই। দেশের ভেতরকার বিরোধে বহির্দেশীয়দের জড়িত করা কখনই মঙ্গলজনক হতে পারে না। এ উপলব্ধি যত দ্রুত আসবে ততই মঙ্গল। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে এমনভাবে তার আসন গেড়ে বসেছেন যে সরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে সেদেশে জনরোষ ধূমায়িত হচ্ছে। আফ্রিকার দেশ বলে তার ওপর আফ্রিকান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ছাড়া অন্য কোনো পাশ্চাত্য শক্তি সেখানে ছড়ি ঘুরাতে পারছে না। আফ্রিকান ইউনিয়নের সুদৃঢ় মনোভাব সত্ত্বেও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে আমরা ফরাসি হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করেছি। তবে শেষ পর্যন্ত এরকম পাশ্চাত্য দেশের হস্তক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আফ্রিকার মহাদেশীয় ঐক্য অন্য মহাদেশের পরাশক্তির হস্তক্ষেপকে অনেকটাই ভোঁতা করে দিয়েছে।

সংবাদপত্রে স্বাধীনতার সূচক নিয়ে এ কলামের ভূমিকায় লেখা হয়েছিল, দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নড়বড়ে হয়ে গেলে সামগ্রিকভাবে গণতন্ত্রও নড়বড়ে হয়ে যায়, এমনকি Illiberal Democracy-তে পরিণত হয়। আজকাল একদল মানুষকে টেলিভিশনের টকশোতে বলতে শুনি, দেশে শত শত দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে এবং দুই ডজনেরও অধিক ইলেকট্রুনিক মিডিয়া বহাল থাকতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কীভাবে ক্ষুণ্ণ হতে পারে? এক পক্ষ অবলম্বনকারী আলোচক অন্যপক্ষ অবলম্বনকারী আলোচকের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আপনি তো সব কথাই বলছেন, তাহলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হল কী করে?’ মাঠে-ময়দানে বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষীয় অনীহা জায়েজ করতে গিয়ে এরা বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ থেকে আমাদের দেশের মতো রাজপথে সমাবেশ ও মিছিল করার রেওয়াজ চলে গেছে।’ এ অজুহাত সর্বৈব সঠিক নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর আমেরিকায় অনেক বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত এমআইটির এমিরিটাস প্রফেসর নোম চমস্কি ডেভিড বার্সামিয়ানকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তা Class Warfare নামক গ্রন্থে গ্রন্থিত হয়েছে। এতে চমস্কি অ্যালেক্স কেরির বরাত দিয়ে বলেছেন, বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই স্বাধীন সংবাদপত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ স্বাধীন সংবাদপত্র পুঁজিবাদের জন্য বিপজ্জনক। সংবাদপত্র চলে গেছে বহুজাতিক কর্পোরেশনের মালিকানায়। এরা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে সংবাদপত্রকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশেও বড় বড় পত্রিকাগুলো বৃহৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানায় চলে গেছে। কারণ একটি সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য যে পরিমাণ পুঁজির প্রয়োজন হয় তা অন্য কারোর পক্ষে জোগান দেয়া সম্ভব হয় না। এ কারণে সংবাদপত্রগুলো অনেকটাই ব্যবসার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আমাদের মতো দেশে ব্যবসার স্বার্থে ক্ষমতাসীন সরকারকে তোয়াজ করে চলতে হয়। এ অবস্থায় গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হয় না। এ পরিস্থিতির সঙ্গে যদি ভয়ের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে তাহলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আরও সীমিত হয়ে আসে।

দেশের তাবৎ রাজনৈতিক দলকে উপলব্ধি করতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রত্যেকের আলোকিত স্বার্থেই অক্ষুণ্ণ থাকা প্রয়োজন। কারণ আজ হোক, কাল হোক কিংবা এক দশকের ব্যবধানে হোক, প্রত্যেক ক্ষমতাসীন দলকে বিরোধী দলে যেতে হবে। তখন অনুভূত হবে সংবাদপত্রের বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কত জরুরি। গণতন্ত্র মানলে সব পক্ষকেই এ নিয়তির কথা ভাবতে হবে। কালাকানুন প্রয়োগ করে কিংবা কারও কণ্ঠরোধ করে আখেরে কারোরই মঙ্গল হয় না। এ দেশে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের ইতিহাস কখনই কণ্টকমুক্ত ছিল না। এমন বাধা এসেছে চরমপন্থী জঙ্গিদের পক্ষ থেকে অথবা ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। বরং এ কথা মেনে নেয়াই শ্রেয়, আমার সমালোচক আমার বড় বন্ধু। এ উক্তিটি করেছিলেন বর্ষীয়ান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তারও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে। তদসত্ত্বেও তিনি সমালোচনা শুনতে উদগ্রীব। আমরা কেন সবাই তার এ যৌক্তিক নির্দেশনা মানব না? এর সঙ্গে প্রয়োজন আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ এড়িয়ে খোলামন নিয়ে নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলা এবং একে অপরের জন্য গণতান্ত্রিক পরিসর সৃষ্টি করা। দেশের সর্বময় মঙ্গলের জন্য এটাই সময়ের দাবি।

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

http://www.jugantor.com/window/2017/05/03/121884